করোনাকাল: বিরোধী রাজনীতিতে নতুন উদ্যোগ!
by সালমান তারেক শাকিল
করোনাভাইরাসের চলমান মহামারি সংকট ও এর পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঈদুল ফিতরের কিছুদিন আগে থেকে ‘ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিকভাবে এ প্রক্রিয়া চলছে। একইসঙ্গে এই উদ্যোগ সফল হলে বিএনপিকে সামনে রেখে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ঐক্য ও নির্বাচনের বিষয়টিও যুক্ত হবে। বিএনপিসহ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তত পাঁচ জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন কথা জানা গেছে।
ঐক্য প্রচেষ্টার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক দলের শীর্ষ নেতারা জানান, করোনাভাইরাস ঠেকাতে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার শুরু থেকেই পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে ভুল করছে। যদিও প্রথম দুই মাস বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে ত্রাণ বিতরণ, সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ বা দাবিতে কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। দলগুলোর নেতারা বলছেন, মূল উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকেই নিতে হবে, সরকারই এই মহামারি মোকাবিলা করবে দেশের জনগণকে নিয়ে। একইসঙ্গে মহামারি শুরু হওয়ার সময় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কয়েকবার ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলা হলেও ক্ষমতাসীনরা তা আমলে নেয়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর দৃশ্যমান ঐক্য ইতোমধ্যে হয়েই গেছে। এখন দরকার অ্যাকশনের, যেটা সরকারের তরফ থেকে না হলে কিছু হবে না। বিরোধী দল কথা বলছে, দেখিয়ে দিচ্ছে, ত্রাণ দিচ্ছে, সহায়তা দিচ্ছে। বিরোধী দলের কথায়ই তো কিছুই হবে না, না লকডাউন হবে, না ডিসটেন্স মেইনটেন হবে, না সরকারি প্রণোদনা বা অনুদান বিতরণ হবে।’
নতুন রাজনৈতিক ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নেতারা জানান, করোনাভাইরাসের শুরু থেকেই সরকারের সিদ্ধান্তগুলো পরিপক্ক ছিল না। এমনকি ছুটি প্রদান ও ছুটি প্রত্যাহার নিয়েও গত কয়েকদিনে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ হিসেবে বিবেচনা করছেন নেতারা। সরকারের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা থাকায় জনগণের মধ্যেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে, এমনটি মনে করছেন নেতারা। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ তৈরির পরিকল্পনা চলছে বিরোধীদলগুলোতে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে ডান ও বাম ঘরানার কয়েকটি দলের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এছাড়া, জেএসডি’র সভাপতি আসম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে কথা বলেছেন সাইফুল হক। ধর্মভিত্তিক একাধিক দলের সঙ্গেও নানা পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদ্যমান বিরোধী রাজনৈতিক জোট যেগুলো আছে, এর একটির মধ্যেও সমন্বয় নেই। বরং প্রতিটি জোটই হয়তো ভাঙন নয় অবিশ্বাস— এই দুইয়ের দোলাচালে ভর করে আছে। সেক্ষেত্রে নতুন বিরোধী জোট ও নেতৃত্ব ঠিক না হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে দাবি আদায় করা যাবে না।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে গুরুত্ব দেয় বিএনপি। ফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এখন দৃশ্যত দুই ভাগ। পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার-অসহিতা এখনও চলছে। ভেঙে গেছে আসম রবের জেএসডি। আগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এখন রবের সঙ্গে নেই। ফ্রন্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এছাড়া, ফ্রন্টের শুরু থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলের প্রতিনিধিত্ব করলেও তারা এখন বিরত রয়েছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানই ফ্রন্টে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন। ফ্রন্টের আরেক শরিক দল মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য কেবল ধারাবাহিকভাবে সক্রিয়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো বিএনপির আরেক জোট ২০ দলীয় জোট। শরিকদের কেউ-কেউ এই জোটকে এখন ‘নজরুল ইসলাম খানের অঙ্গ-সংগঠন’ বলে থাকেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবস্থা অনেকটাই কেবল নামমাত্র। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দীর্ঘদিন দৃশ্যমান কোনও সম্পর্ক নেই। একইসঙ্গে হাইকোর্টের আদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন স্থগিত থাকা দলটি ২০১৯ সালের শুরু থেকে অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে একাধিক নেতার পদত্যাগ, বহিষ্কার, সেক্রেটারি জেনারেল পদ নিয়ে নানামুখী দ্বন্দ্ব রয়েছে। দীর্ঘদিনের জোট শরিক ইসলামী ঐক্যজোট, জেবেল রহমান গাণির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, আন্দালিভ রহমান পার্থ’র নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবং এনডিপি বিএনপিকে ছেড়ে আলাদা রয়েছে। এর বাইরে বাকি দলগুলোর অবস্থাও শোচনীয়, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি ছেড়ে গেছেন এম এম আমিনুর রহমান। দু’ভাগ রয়েছে জাগপা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক পার্টেতেও।
বামজোটের একাধিক নেতা জানান, ২০১৮ সালে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা মিলে গঠন করা হয় বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই জোটেও দৃশ্যমান ঐক্য নেই। ‘প্রেস রিলিজ কেন্দ্রিক ঐক্য’ যেটুকু আছে, তাও ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টায়। গত দুদিন ধরে জোটের এক নেতার করোনাআক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে জোটের ও জোটের বাইরের বাম দলগুলোর নেতাকর্মীরা নানামুখী অবস্থান ব্যক্ত করছেন। এই জোট গত ১৩ এপ্রিল ‘সর্বদলীয় পরামর্শ সভা’ করলেও সেই থেকে আর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। একাধিক বাম নেতা জানান, এরপর করণীয় নির্ধারণ নিয়ে মত পার্থক্য থাকায় প্রক্রিয়াটি আদতে বন্ধ। তারা বলেন, ‘একাধিক বাম দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিব্রত করার মতো কোনও কার্যক্রম বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিচ্ছুক।’
করোনাকালে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকা একাধিক নেতা জানান, বিদ্যমান যে রাজনৈতিক জোটগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে আবেদন তৈরি করে জনগণের সামনে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। সে কারণেই বিএনপিসহ অন্যদের সঙ্গে মিলে সর্বদলীয় ঐক্য করা এখন প্রয়োজন। বিদ্যমান জোটগুলোকে অক্ষুণ্ন রেখে এই প্রক্রিয়া কেন্দ্র থেকে শুরু না করে জেলা পর্যায় থেকে করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে যশোর, মাগুরা, দিনাজপুর এলাকায় এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। এই কমিটিগুলো হবে— গণতদারকি কমিটির মতো। সব দলের সব প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ত্রাণ বিতরণ, মানুষের অনাহার ও স্বাস্থ্যবিষয়ক যেকোনও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম এবং সরকারি ত্রাণ ও ব্যবস্থাপনা মনিটরিং করা হবে।
জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘জাতীয় সমস্যায় জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। আমরা তো শুরু থেকেই সরকারের প্রতি আহ্বান রেখেছিলাম। কিন্তু তারা তো আসেনি। এরপরও আমাদের আহ্বান আমরা অব্যাহত রেখেছি। ওবায়দুল কাদের এখন অব্যাহতভাবে একমাস ধরে আহ্বান জানাচ্ছেন, এটা তো একটা বুলিমাত্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি তার প্রবল প্রতিপক্ষদের সঙ্গে কথা বলছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন। আর আমাদের সরকার সাধারণ কোনও বিরোধী দলের সঙ্গে ন্যূনতম সৌজন্যতাও দেখায়নি।’
সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা এখন চেষ্টা করছি, একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ গড়ে তুলতে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের নানা পেশার মানুষকেও যুক্ত করা প্রয়োজন। এই চেষ্টা কেবলমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ে, আমরা খুবই অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে আলোচনা করছি।’
উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ জানান, বিএনপির মধ্যে নতুন উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার আপিল আছে। এমনকি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকেও সমন্বিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ইতিবাচক অবস্থান রয়েছে। বিএনপির মহাসচিব ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপে দলের এ আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন কোনও উদ্যোগের বিষয়ে বলতে পারবো না। কাজ করছি। বলার মতো কিছু হয়নি।’
নতুন ঐক্য গড়ে তুলতে সক্রিয় এমন দুই নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, করোনা পরিস্থিতি সামগ্রিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনবে। মহামারি মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ আসবে। সেদিক থেকে বিবেচনা করে হলেও রাজনৈতিকভাবে পুরো পরিস্থিতির সম্ভাব্য যাচাই করে একটি উদ্যোগ কার্যকর করা প্রয়োজন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আছে, ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনগণের কোনও উদ্যোগ সামনে আসলে নিশ্চয়ই দলের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত দেবেন।’
আরও পড়ুন:
শর্তসাপেক্ষ মুক্তি: পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সক্রিয় খালেদা জিয়া