করোনাকালের আমি ও আমরা
by নওরোজ কোরেশী দীপ্তকরোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
বাংলাদেশের অনেক তরুণের মতো সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে আসা একজন গ্র্যাজুয়েট বলছি। আমার বা আমার চারপাশে থাকা আমাদের অবস্থাটা বেশ নাজুক। এমন একটা অবস্থানে আমরা আছি, না এখনো কোনো নির্দিষ্ট নৌকায় চড়েছি, না আছে কোনো হাল ছেড়ে দেওয়ার পথ।
গত পাঁচ-সাত বছর নিজ পরিবার থেকে, নিজের মনস্তত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে শুধু প্রথাগত অর্জন আর কাগুজে সার্টিফিকেটের পেছনে ছুটে বেড়ানোই ছিল জীবনের অর্থ।
হঠাৎ জেঁকে বসা করোনা অনেকটা অচল করে রেখেছে বিশ্ব। বিশ্ব শব্দটা কেমন যেন কৃত্রিম ঠেকে আমার কাছে, তাই ধরিত্রী বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। ধরিত্রী শব্দটায় যেন ঠিক এই সময়ের বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ রয়েছে, যা আমাদের প্রকৃতির শিকড়ের সঙ্গে জড়িত। ধরিত্রীর এই গন্ধটাই যেন মনে করিয়ে দেয়, একজন ‘আমি বা আমরা’র গল্প।
করোনার থাবা যেন সেই আমি বা আমরার সঙ্গে যোগাযোগটা শক্ত করারই একরকম প্রাকৃতিক আহ্বান। আহ্বানটা আমি বা শত শত আমরার শিকড়ের। নিজেকে আবার সময় দেওয়ার, নিজেকে আবার খুঁজে বেড়ানোর, আত্মোপলব্ধির, আত্মোন্নয়নের। সামনে নেই কোনো সেমিস্টার ফাইনালের তাড়া, নেই কোনো চাকরির পরীক্ষার চাপ। সদ্য গ্র্যাজুয়েট বা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ দিকে থাকা আমাদের সবার ঘাড়েই চেপে বসে পার্থিব অর্জনের চিন্তা, নানা দায়িত্ব-কর্তব্যের বোঝা। কিন্তু এর মাঝেও এই করোনাবেলায় বাস্তবিক জগতে সবার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, যাকে আমরা ‘লকডাউন’ বলে অভিহিত করছি, খুলে দিয়েছে নিজের শিল্পমন ও নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরাল করার নতুন দুয়ার।
করোনা আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে হাজারো বই পড়ার, যে বইগুলোতে ধুলো পড়ে ছিল বছরের পর বছর। সুযোগ করে দিয়েছে নিজের গান-নাচ, আঁকাআঁকি, লেখালেখির প্রতিভাগুলো আরেকবার ঘুরে দেখার, কারও কারও জন্য তা যেন নতুন করে আবিষ্কারের আহ্বান। শান্ত নগরীতে নতুনভাবে নিজের ভেতরের সুপ্ত শিল্পগুণগুলো উপলব্ধি করে নিজেকে মেলে ধরার। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও দারুণভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে আমাদের। কেউবা নিজের ই-লাইব্রেরির বিশাল সংগ্রহশালা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে, কেউবা নিজেরা নিজেরা নিজেদের শিল্পকলাগুলো মানুষের মাঝে তুলে ধরে নিজের শিল্পগুণকে আরও সমৃদ্ধ করার জ্বালানি খুঁজে নিচ্ছে। কেউ হয়তো নিজের হাতে নিজের ঈদের কাপড় বানিয়ে সময়যাপন করছে, কেউবা নিজের রন্ধনশৈলীর নতুন গুণ আবিষ্কার করে চলেছে। নিজেকে চেনার চেয়ে সুন্দর, সুদীর্ঘ ও একাকী উপলক্ষ কি আর পাওয়া সম্ভব কখনো?
এই আমরা বুঝতে শিখছি সম্পর্কের মূল্য। একদিকে বন্ধুবান্ধবের মাঝে সপ্তাহের পর সপ্তাহ দেখা না হওয়ার অনুভূতি যেমন আমাদের সম্পর্কগুলোর চারপাশে জড়ানো কৃত্রিম বেড়াজাল ভেঙে দিচ্ছে, অন্যদিকে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো আমাদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ৫-৭ বছরে তৈরি হওয়া মানসিক দূরত্বকে হ্রাস করে চলেছে। বাবার পারিবারিক দায়িত্ব থেকে মায়ের রান্নাবান্নায় হাত বাড়ানো, ভাইয়ের পড়াশোনা থেকে বোনের চিন্তাভাবনার জগৎকে আরেকটু বুঝতে শেখার এমন সুযোগ কি আর পাওয়া সম্ভব কখনো?
নেতিবাচকতা মানুষকে ঠেলে দিতে শুরু করে পেছন দিকে। ঠেলতে ঠেলতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, মানুষ তখন নতুনভাবে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে নেয়। এবারও হয়তো নানা মনস্তাত্ত্বিক বাঁধ আমাদের তথাকথিত স্বাভাবিক জীবন না পাওয়ার নেতিবাচকতাকে জমা করে চলছিল, কিন্তু নিজেকে নানা নতুন ও নানা শখ-প্রতিভার সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে আবারও নিজেকে চেনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। নিজেকে নিজের ও পরিবারের মাঝে বিস্তৃত করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নিজ ‘বিশ্ব’ হতে নিজ ‘ধরিত্রী’কে চেনার নতুন দৃষ্টিকোণ।
করোনা একদিন পরাজিত হবেই। আমাদের সেই জয় যেন হয় নিজেকে ফিরে পাওয়ার, নিজেদের ফিরে পাওয়ার, নিজেকে ও নিজেদের সম্পর্কগুলোকে নতুনভাবে চিনতে শেখার। আমি আর আমরা যেন জীবনযুদ্ধের ধূসর প্রান্তরের যুদ্ধ করে না চলি সেই চিরচেনা অতীতের মতো ভবিষ্যতের ধরিত্রীতে। যেন বৃষ্টিস্নাত রঙিন দিনে আবারও মাটির গন্ধ মনে করিয়ে দেয়, আমি শুধু কৃত্রিম বিশ্বের অংশ নই, আমি নিজের মাঝে এক শৈল্পিক ধরিত্রী। মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয়ের সার্থকতা সেখানেই।
*লেখক: শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। dipto.pme.45@gmail.com