অভিবাসীরা উপেক্ষিত

by

অভিবাসনের দেশ আমেরিকায় করোনাভাইরাসের চলমান সমস্যা ও সংকটে উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। এরই মধ্যে করোনায় আমেরিকায় মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সঠিক পরিসংখ্যান এখনো না আসলেও আমেরিকানদের তুলনায় অভিবাসীরাই করোনার শিকার হচ্ছে বেশি। নিউইয়র্কের উদাহরণ নিলে দেখা যায়, এখানে অনগ্রসর কমিউনিটির মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। আমেরিকায় যাদের অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের মূল শক্তি হিসেবে ধরা হয়, করোনার এই মহাসংকটে তাঁদের পক্ষে কেউ নেই। এমনকি যে বিভাগটি আমেরিকার ইমিগ্রেশন দেখভাল করে, সেই ইউএসসিআইএসকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। আগামী মাসের মধ্যে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পেলে মার্কিন ইমিগ্রেশন বিভাগের বহু লোক কাজ হারাবে। ভেঙে পড়া অভিবাসন ব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠবে বলে মনে করছে অভিবাসী গ্রুপগুলো।

 মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাস মহামারি ও দেশে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে আমেরিকায় সব ধরনের অভিবাসন স্থগিত রাখার উদ্যোগের পর ইমিগ্রেশন সার্ভিসের কাজ  থমকে পড়েছে। কিছু রুটিন কাজ ছাড়া প্রায় তিন মাস ধরে ইমিগ্রেশন বিভাগসহ বাইরের দেশের কনস্যুলেট অফিসে অভিবাসন প্রক্রিয়ার সব কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধই রয়েছে। ইমিগ্রেশন বিভাগের উল্লেখযোগ্য আয় এসে থাকে আবেদনপত্র ও বিভিন্ন ফরমের ফি থেকে। সঠিক হিসাব না জানা গেলেও অভিবাসী আইনজীবীদের মতে, এই আয় অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। যার কারণে এই সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন এজেন্সি ডেপুটি ডিরেক্টর জোসেফ এডলো।

এদিকে ইউএসসিআইএসের কর্মীরা জুলাইয়ের শেষের দিকে কংগ্রেসের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার জরুরি তহবিল না পেলে প্রায় ১০ হাজার ৮০০ জনকে সাময়িক ছুটি নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের একজন সদস্য।

করোনাভাইরাস মহামারিতে ইউএসসিআইএস অবৈধ নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট, গ্রিনকার্ড, আশ্রয় আবেদন এবং অন্যান্য অভিবাসন সুবিধাগুলো আসছে সেপ্টেম্বরে ৬১ শতাংশে নেমে আসবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

মহামারির এই সময়ে তীব্র সংকটের কথা তুলে ধরে ইউএসসিআইএস এই মাসের গোড়ার দিকে দুই বছরে জন্য কংগ্রেসের কাছে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তহবিল চেয়েছিল। ইউএসসিআইএস মার্কিন ট্রেজারি বিভাগকে এই অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

শুধু অভিবাসন বিভাগের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন যে উদাসীন তা নয়, করোনাভাইরাসের বিপর্যয়ের সময়ে আমেরিকায় থাকা বিপুলসংখ্যক অভিবাসীদেরও চরম উপেক্ষার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। নথিপত্রহীন প্রায় ২০ লাখ অভিবাসীদের জন্য কোন প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। করোনাভাইরাস গ্রিনকার্ড দেখে কাউকে আক্রমণ করেনি। যেসব অভিবাসী দিনের পর দিন স্বল্প মজুরিতে কাজ করে আমেরিকার অর্থনীতি সচল রেখেছেন, তাদের জন্য মানবিক কোন সহযোগিতার কথা বলা হয়নি ট্রাম্পের আমেরিকায়।

উপরন্তু নিয়মিত ইমিগ্রেশন সাময়িক বন্ধ করেছেন। নিজের রক্ষণশীল সমর্থকদের উসকে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক চাল চালছেন ট্রাম্প। রক্ষণশীলদের ভোট পাওয়ার জন্য ট্রাম্পের এই নিষেধাজ্ঞা বর্ধিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে অভিবাসী গ্রুপগুলো।

উদারনৈতিক নগরগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়াসহ বেশ কিছু রাজ্যে চলমান করোনা বিপদের সময়ে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের সীমিত হলেও উদারতা দেখিয়েছে। নিউইয়র্কে ফ্রি খাবার সরবরাহ করার সময়ে কারও বৈধতা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে না। নথিপত্রহীনদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা দিয়েছে নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কের বাইরের এসব অভিবাসী চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছে।

কংগ্রেসে প্রথম দফা নাগরিক সহযোগিতা প্রণোদনায় কোন মার্কিন নাগরিক নথিপত্রহীন অভিবাসীকে বিয়ে করলেও প্রণোদনার অর্থ দেওয়া হয়নি। দুই সপ্তাহ আগে ডেমোক্র্যাটদের উত্থাপিত নতুন প্রস্তাবে বিপদাপন্ন অভিবাসীদের জন্য কিছু অনুকম্পা প্রস্তাব আনা হলেও চূড়ান্ত সমঝোতায় অভিবাসীরা কোন সুবিধা পাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

করোনাভাইরাসে ইউএসসিআইএসের সাময়িক কার্যক্রম স্থগিতে খুব কঠিন সময় পার করছে কাগজপত্রবিহীন মানুষেরা। যাদের পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম আছে, তাঁদের দুশ্চিন্তার পাহাড়। এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশি নাবিদ হোসেইনের সঙ্গে। রাতুল প্রায় ৭ বছর ধরে নিউইয়র্কের কুইন্সে বসবাস করছেন। কাজ বন্ধ থাকার পর এখনো ওয়ার্ক পারমিট না পাওয়ায় ৩ মাস ধরে ঘরবন্দী। খাবার সংকট ছাড়াও অর্থ সংকটে আছেন, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেটাও বললেন এই প্রতিবেদককে। নিজের লজ্জা আর ধরে না রাখতে পেরে অর্থ সাহায্য কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাও জানতে চাইলেন।

রাতুলের মতো করুণ অবস্থা ব্রুকলিনের আবুল হোসেনের অবস্থা। দেশে একসময় আলোকচিত্র হিসেবে ভালোই ডাকনাম ছিল। জীবিকার তাগিদে সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে আমেরিকা আসলেন ঠিকই, তবে করোনা সব স্বপ্ন ভেঙে ফেলেছে বলে জানালেন তিনি। বেকারভাতা পাচ্ছেন না। কারণ এখনো কাজের বৈধতা পাননি। কাজ করতেন ব্রুকলিনের বাংলাদেশি মালিকানাধীন আবদুল্লাহ রেস্টুরেন্টে। করোনায় সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে বর্তমানে অর্থসংকটে দিন কাটাচ্ছেন।

যাদের ওয়ার্ক পারমিট আছে তবে কাজ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে তাঁরাও যে সুখে নেই এমনটি জানালেন বাংলাদেশি নুসরাত। কাজের বৈধতা আছে, কিন্তু পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম কেস এখনো ঝুলে আছে। ফলে ভবিষ্যতে কাজ পাওয়া নিয়ে বা কি বা ভবিষ্যৎ সেটাও একটি আতঙ্ক এমনটি বললেন তিনি।

 একদিকে বিশ্বের শক্তিধর দেশ আমেরিকা এখন বিপন্ন সবদিক থেকে। অর্থনীতির চাকা কবে সচল হবে, মন্দা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, এ নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। যারা বৈধ অভিবাসী, তারা বেকার ভাতা পাচ্ছেন। নথিপত্র ঠিক নেই, অভিবাসনের আবেদন ঝুলে আছে—এমন লোকজন কোন সুবিধাই পাচ্ছেন না।

 আমেরিকার রাজনীতিতে এখন রক্ষণশীলতা তুঙ্গে। বিপদের এ সময়েও দেশটি এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা তাদের অবস্থা সংহত করছে। পাশাপাশি উদারনৈতিক বলে পরিচিত ডেমোক্র্যাটরাও জাতীয়ভাবে অভিবাসীদের পক্ষে কোন জোরালো বক্তব্য রাখছেন না। ফলে অভিবাসনের দেশ বলে আমেরিকার যে অভিবাসীরা গর্ব করতেন, বিপদের সময়ে সে গর্বের উচ্চারণটিও ক্রমশ ম্লান হয়ে উঠছে।