জীবন এগিয়ে যাবে
করোনায় মৃতদের স্মরণ
১৯১৮ সালের বসন্তকাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে যখন গোলাবারুদ ফুটছে অনেকটা স্বয়ংক্রিয় ঢংয়ে, তখন জনপদে হানা দিল এক অচেনা অজানা শত্রু। স্প্যানিশ ফ্লু, যা ‘এর আগের ও পরের জীবনের মধ্যে গড়ে দিল বিস্তর ব্যবধান’, যা যুদ্ধও পারেনি। এই ব্যবধানের কথাটি বলেছেন ক্যাথরিন পোর্টার, যিনি স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এই বদলের কথা বলেছেন, যা ব্যক্তির পরিসর ডিঙিয়ে সমষ্টিকেও আক্রান্ত করেছিল।
আজকের পৃথিবী এমনই এক বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এবার এই বদল নিয়ে আসছে নতুন করোনাভাইরাস। মাত্র পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাস আগেও যা ভাবা যেত না, পাঁচ মাসের মাথায় এসবই এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মাত্র পাঁচ মাসে এ বিশ্ব হারিয়েছে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষকে। এই পাঁচ মাসে মানুষের বাইরের পৃথিবী ভীষণভাবে সংকুচিত হয়েছে। এই পাঁচ মাসে দেশে দেশে থাকা সীমানা হঠাৎ করেই প্রকট হয়ে উঠেছে। সুরক্ষার স্বার্থে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষ এক অভিনব সামষ্টিক বোধের দেখা পেয়েছে। বদলে গেছে অনেক হিসাব-নিকাশ।
আমেরিকার কথা বিবেচনা করলে এই হাসব বদলে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র তিন মাসে। মাত্র তিন মাসে আমেরিকার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে এক লাখের বেশি মানুষ। কোভিড-১৯ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এক লাখ মানুষের মুখ, তাদের হাসি, তাদের কান্না, তাদের করা সম্ভাষণ সব মুছে দিয়েছে। সব এখন ফটোগ্রাফ। আজকেই যদি পৃথিবী স্বাভাবিক হয়, তবে আমেরিকার পথে অন্তত এক লাখ মানুষের পায়ের ছাপ পড়বে না আর। এই বিয়োগ এমনকি এই বিয়োগের জন্য তাদের মৃত্যুশয্যার পাশে বসে প্রিয়জনেরা কাঁদতেও পারেনি। প্রিয়জনের আলিঙ্গন ছাড়াই এক তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে পাড়ি জমাতে হয়েছে মানুষকে।
এই দুর্যোগে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি অনেকে মারা গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৭০ জন বাংলাদেশি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অন্য সবার মতো তাদের মৃত্যুশয্যায় কোনো প্রিয়জন থাকতে পারেনি। অন্য সবার মতো তাঁদের শেষকৃত্যও হয়েছে এমনকি কোনো আয়োজন ছাড়া। শেষ বিদায় জানানো জন্য কেউ ছিল না। শুধু করোনা কেন এই দুর্যোগকালে অন্য যেকোনো কারণে মারা যাওয়া মানুষের শেষকৃত্য বলতে কিছু ছিল না। সবাইকে নীরবে, নিভৃতেই চলে যেতে হয়েছে। এই চলে যাওয়া মানুষদের স্মরণ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস যে বিশেষ আয়োজন গত সপ্তাহে প্রকাশ করেছে, তা সত্যিই অনুসরণীয় এবং প্রশংসার যোগ্য।
এই কোভিড-১৯ মহামারির কালে আক্রান্তদের একটি বড় অংশকেই আমরা ফিরে পেয়েছি সুস্থ্য হিসেবে। এই ফিরে আসা মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে গ্রহণ করা এবং তাদের দুর্যোগ পরবর্তী জীবনে থিতু হতে সাহায্য করাটা ভীষণভাবে জরুরি। যারা ফিরে এসেছেন মৃত্যুর দরজা থেকে, তাদের অভিবাদন জানানো মানে জীবনকেই অভিবাদন জানানো। জীবনকে জানানো এই সম্ভাষণ সম্মানিত করবে মৃতদের নিভৃত চলে যাওয়াকে। আর এই জায়গা থেকেই পৃথিবীর সব প্রাণময় সত্তার পক্ষ থেকে করোনায় মৃত ও ফিরে আসা সবার প্রতি থাকল অভিবাদন।