অনলাইন কেনাকাটা চার গুণ বেড়েছে

♦ ঈদে ডেলিভারি সক্ষমতার চেয়ে তিন গুণ বেশি অর্ডার ♦ লকডাউনে যুক্ত হয়েছেন অনেক নতুন ক্রেতা ♦ ডিজিটাল পেমেন্ট বেড়েছে দ্বিগুণ

by

ফারিয়া ফারুক চৌধুরী (৩১) বসবাস করেন রাজধানীর শ্যামলীর খিলজি রোডে। স্মার্টফোন ব্যবহারে পারদর্শী এই গৃহিণী অনলাইনে কেনাকাটা করেন। চাল, ডাল, সবজি, মাছ-মাংস, দুধ, গৃহস্থালি পণ্য ঘরে বসেই কিনে ফেলেন। ঈদের কয়েকটি দরকারি পণ্য তিনি অনলাইনে কিনেছেন। নগদ অর্থের লেনদেন না করে পণ্যের বিলও পরিশোধ করেছেন ক্রেডিট কার্ডে।

করোনা মহামারির সংক্রমণ থেকে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি স্বামীকে বাজারে না পাঠিয়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। ফারিয়ার মতো অসংখ্য নারী-পুরুষ এখন অনলাইনেই সেরে নিচ্ছেন দরকারি কেনাকাটা। করোনা সংক্রমণ কমাতে দেশের বড় বড় শপিং মল ও মার্কেটগুলো বন্ধ থাকায় এবার ঈদের কোনাকাটায় প্রধান ভরসা হয়ে ছিল অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। এতে ই-কমার্স খাতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পণ্যের অর্ডার বেড়েছে চার গুণের বেশি। এ ছাড়া মুদি পণ্যে পাঁচ গুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশের শীর্ষ ই-কমার্স কম্পানিগুলো। একই সঙ্গে করোনাভাইরাসের পর ডিজিটাল মাধ্যমে পেমেন্টের হার ছিল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমে পেমেন্টের হার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে লকডাউনের কারণে বিক্রেতা ও ডেলিভারি কর্মীর সংকট না থাকলে আরো প্রবৃদ্ধি হতো বলে জানা গেছে।  

দেশের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও পোশাক, পাদুকা, ইলেকট্রনিক পণ্য, মোবাইল ফোনসেট বিক্রি করছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি অংশ টিকে থাকার জন্য অনলাইনকে বেছে নিয়েছে। দেশের শীর্ষ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো রমজান ও ঈদের কেনাকাটার অর্ডারে ব্যাপক উত্থান দেখতে পাচ্ছে। যদিও ডেলিভারি সমস্যার কারণে তারা সব অর্ডার নিতে পারছে না। চালডাল, দারাজ, আজকের ডিল, বাগডুম, প্রিয় শপ, রকমারি, পিকাবু, অথবা, ই-ভ্যালি, বিক্রয়সহ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো পণ্য বিক্রির পাশাপাশি বিক্রেতাদেরও বিনা মূল্যে অনলাইনে দোকান খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে সফটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস আজকের ডিল ডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলতি মাসে ই-কমার্সে পণ্য বিক্রির পরিসর বাড়ানোর ফলে আমরা ভালো প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। ঈদে ব্যাপক চাহিদা এসেছিল’ কিন্তু আমরা সব অর্ডার নিতে পারিনি। এ সময় ৬০ শতাংশ অর্ডার বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে উপজেলা পর্যায় থেকেও আমরা প্রচুর অর্ডার পেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যানবাহন বন্ধ থাকায় পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ কারণে বেশ কিছু অর্ডার বাতিল করতে হয়েছে।’

করোনার মধ্যে গত এক মাসে আড়াই লাখ অর্ডার ডেলিভারি দিয়েছে চালডাল ডটকম। এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা জিয়া আশরাফ বলেন, ‘করোনার এই সংকট সময়ে আমরা দেশের মানুষের পাশে থাকতে পেরে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সাপ্লাই চেইন সচল রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। পোস্ট অফিসের গুদামসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ওয়্যারহাউস সুবিধা বাড়ানো গেলে আরো বেশি মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব।’

দারাজ বাংলাদেশের হেড অব পিআর, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন শায়ন্তনি তিশা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লকডাউনের কারণে বিক্রেতা ও ডেলিভারি কর্মীর সংকট ছিল। তার পরও মুদি পণ্যে পাঁচ গুণ এবং অন্যান্য পণ্যে তিন থেকে চার গুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোনের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যের বিক্রি কমেছে। আমরা আশা করছি, লকডাউন শিথিলের পর প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে।’

সাধারণ ছুটিতে অনেক ডেলিভারি কর্মী বাড়ি চলে যাওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলে জানালেন ই-কমার্স ব্যবসার অন্যতম লজিস্টিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান পেপারফ্লাইয়ের পরিচালক ও প্রধান বিপণন কর্মকর্তা রাহাত আহমেদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদের কারণে অর্ডারের চাপ ছিল। বড় সুপারশপগুলো বন্ধ থাকায় অনেকে অনলাইনে কেনাকাটা করছেন। আমরা আড়ং, এপেক্সসহ শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য সরবরাহ করছি। ঢাকার বাইরে আমরা ৫৫টি জেলা সদরে আমাদের নিজস্ব কর্মী দিয়ে পণ্য পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে পণ্য পাঠানো যায়নি। আমাদের ডেলিভারি পারসন অনেকে সাধারণ ছুটিতে বাড়ি চলে গেছেন। বিভিন্ন ইনসেনটিভ দিয়ে কিছু মানুষ নিয়েছি। তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। তার পরও আমরা সময়মতো পণ্য সরবরাহের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।’

সুপারশপগুলোরও রয়েছে বাসায় পণ্য পৌঁছে দেওয়া বা হোম ডেলিভারি সেবা। ঈদে সেখান থেকেই অনেকে অর্ডার করেছেন সেমাই, চিনি, মসলাসহ নানা পণ্য। এ ছাড়া নিয়মিত পণ্য চাল, ডাল তো আছেই। সুপারশপ স্বপ্নের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পাতায় নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের স্টোরের ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। আপনার বাসা যদি স্বপ্ন স্টোরের দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকে, তাহলে তারা পণ্য পৌঁছে দেবে। এ ছাড়া মিনাক্লিক, আগোরাসহ আরো কিছু সুপারশপ হোম ডেলিভারি দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে পণ্যের অর্ডার করে টাকা পরিশোধ করা যাবে নগদ, মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংকের ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে।

ঈদের কোনাকাটায় বড় অংশজুড়েই থাকে পোশাক। কিন্তু করোনার কারণে এবার ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানালেন দেশের ফ্যাশন ডিজাইনারদের সংগঠন ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) সভাপতি মাহিন খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে দেশের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো যথেষ্ট পরিমাণ পোশাকের প্রস্তুতি নিয়েছিল। বড় ফ্যাশন হাউসগুলো ছয় মাস আগেই ঈদ ফ্যাশনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। করোনাভাইরাসের কারণে দোকান বন্ধ থাকায় সব প্রস্তুতি মাটি হয়ে গেছে। এই খাতের ছোট উদ্যোক্তারা এবং ক্রেতাদের একটি বড় অংশ অনলাইনে পোশাক বেচাকেনায় খুব একটা অভ্যস্ত না হওয়ায় এই খাত কঠিন সময় পার করছে। তবে কিছু ব্র্যান্ড যারা আগে থেকে অনলাইনে ছিল তারা অনলাইনে কিছু পোশাক বিক্রি করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।’

ই-কমার্সের জন্য করোনাভাইরাস আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে বলে জানালেন ই-কমার্স লজিস্টিক কম্পানি ই-কুরিয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব ঘোষ রাহুল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার আগে অনলাইন কেনাকাটা মানুষের অগ্রাধিকারে ছিল না। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। শুধু ক্রেতা নয়, প্রতিটি কম্পানিও এখন ই-কমার্সকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’