চলচ্চিত্রকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার আড়ালে চলে গেছে
by শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকাবাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নায়ক জায়েদ খান করোনার সময়ে অসহায় শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চলচ্চিত্র ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে।
এই করোনার সময় আপনি শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কোথা থেকে?
আমি ছোটবেলা থেকেই পিরোজপুরে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি জেলা ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলাম। তাই নেতৃত্বের ব্যাপারটি ছোটবেলা থেকেই ছিল। শৈশবে মা–বাবাকে দেখেছি গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যার কারণে চলচ্চিত্রে আসার পর তা প্রবলভাবে নাড়া দেয়। যখন দেখি, বাইরের দেশের তারকারা প্রচুর সহযোগিতা করছে মানুষকে, তখন এই আগ্রহ আমার আরও বেড়ে যায়। তাঁদের মতো অতটা সাধ্য নেই, কিন্তু ইচ্ছা আছে। সেই জায়গা থেকে আমি এই মহামারিতে নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। কাঙ্গালীনি সুফিয়া, শিল্পী আকবর এ রকম অনেকের পাশে দাঁড়িয়েছি। একজনের সন্তানের দুধ কেনার টাকা ছিল না। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি মনে করি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
করোনা–পরবর্তী চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলে আপনার ধারণা?
এমনিতেই আমাদের চলচ্চিত্র অনেক দিন ধরেই একটু খারাপ অবস্থায় যাচ্ছে। লগ্নিকারক আসছিলেন না। এখন অনেক লগ্নিকারক টাকা লগ্নি করবেন না। দ্বিতীয়ত, হলগুলো কবে নাগাদ খুলবে এবং হলগুলো খুললে কীভাবে পরিচালিত হবে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চালানো সম্ভব হবে কি না, ভাবার বিষয়। কারণ হলো মালিকেরা চাইবে বেশি ব্যবসা করতে। সে ক্ষেত্রে সিনেমা হলও ক্ষতির সম্মুখীন। সেটা করোনো সংক্রমণের ওপর নির্ভর করছে। এ ছাড়া একটা শুটিংয়ে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক থাকে। এরপর ক্লোজ শট দিতে গেলে সহশিল্পীদের পাশাপাশি থাকার ব্যাপার আছে। শুটিংয়ে নানা ধরনের লোক থাকে। কলাকুশলী থাকে। সবকিছু মিলে এই শুটিংটা কতখানি ঝুঁকিমুক্তভাবে করতে পারা যাবে, সেটাও চিন্তার বিষয়। কারণ আজকেও (গতকাল) দুই হাজার আক্রান্ত। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার থামছেই না। যদি বুঝতাম যে সারা দিনে বা দুই–তিন দিন পর একজন মারা গেছে, তখন বুঝতাম যে একটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। সে ক্ষেত্রে শুটিংয়ের ঝুঁকি অনেক সিরিয়াস পর্যায়ে আছে। সবকিছু মিলে একটা প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি।
সে ক্ষেত্রে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে? কীভাবে সামনের দিনগুলোতে এগোবেন?
আমাদের সঙ্গে জড়িত অনেক সংগঠন। পরিচালক, সহকারী পরিচালক, কলাকুশলীসহ নানা সংগঠন কাজ করছে। তারা এবং এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ আমরা বসব। কীভাবে কাজ করতে পারি, সে ব্যাপারে কথা বলব। আউটডোর শুটিং অবশ্যই বন্ধ থাকবে। এফডিসির মধ্যে সীমিত আকারে করতে পারি কি না। আমরা বাঙালিরা কিন্তু আবার সীমিত বুঝি না। আমরা সীমিত করতে গিয়ে পরিমিত বোধ রাখতে পারি না, আগের মতোই করে ফেলি। সে ক্ষেত্রে এফডিসির ফ্লোর জীবাণুমুক্ত করে মাস্ক পরে কাজ করতে পারি কি না, আলোচনা করব। কিন্তু যতই হোক ক্যামেরার সামনে তো আর মাস্ক পরে অভিনয় করতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে অলটারনেটিভ কী করা যায়? সিনিয়র শিল্পীদের সঙ্গে বসে আলোচনা করব। এরপর সব সমিতি এফডিসির এমডির সঙ্গে বসে একটা রূপরেখা তৈরি করব। কীভাবে কী করতে পারি তা নিয়ে।
করোনার এই প্রভাবে বিশ্বজুড়ে স্ট্রিমিং সাইটগুলোর দাপট বেড়ে গেছে। অনেক দেশের ছবিই স্ট্রিমিং সাইটে মুক্তি দিচ্ছে। আপনাদের এ নিয়ে কোনো ভাবনা আছে?
এখন প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। মানুষের বিনোদন হাতের মুঠোয়। মোবাইলের অ্যাপসেই এখন সবকিছু দেখা যাচ্ছে। যদিও সত্যি বলতে লজ্জা নেই, আমরা প্রযুক্তির দিক দিয়ে এখনো অতটা এগোতে পারিনি। যদিও এখন এমন পরিকল্পনা আমরা করিনি। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে আমরা বুঝতে পারব পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। যদি এমন হয় যে হল খোলা যাচ্ছে না। হলে এখন গেলে রিস্ক। মানুষের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে বিকল্প পথে এগোতে হবে। কারণ যদি ১০০ সিনেমা হলের মধ্যে করোনার জন্য ২০ থেকে ৩০টি চালু হয়, সাহস করে কেউ না খোলে, তখন আমাদের অন্য পদ্ধতিতে হাঁটতে হবে। তা ছাড়া এই চলচ্চিত্রকে বাঁচানোর অন্য কোনো বিকল্প পথ থাকবে না।
আপনার ফেসবুক পেজে ইন্ট্রোতে লেখা আছে নীতিগতভাবে আমরা এক। একটু বিশ্লেষণ করবেন?
এটা প্রথম যখন নির্বাচন করি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে, তখন আমরা সিনিয়রদের নিয়ে একটা মিটিং করলাম। সেখানে ইন্ডাস্ট্রির কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ–আলোচনা করলাম। তখন সে বিষয়টায় সবাই নীতির দিক থেকে একমত পোষণ করলাম। আমাদের কথা ছিল সিনিয়র ও জুনিয়রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিল্পী সমিতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা কিন্তু সে কথা রেখেছি। কারণ সিনিয়ররা অনেকেই এফডিসি থেকে দূরে ছিলেন। এখন তাঁদের আপনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে দেখবেন। আমরা তাঁদের এক জায়গায় করেছি। সেটা ছিল এই স্লোগানটি, যে যাঁরা আমাদের এই নীতির সঙ্গে এক, তাঁরা, আমরা সবাই নীতিগতভাবে এক।
সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়ার কারণে ক্যারিয়ার কি আড়ালে চলে গেছে? কী মনে হয় আপনার?
হ্যাঁ, অবশ্যই আড়ালে চলে গেছে। আমি মনে করি, আগে আমি অভিনেতা, তারপর নেতা। চলচ্চিত্রকে ভালোবাসতে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার আড়ালে চলে গেছে। তবে এই অঙ্গনে যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁরা দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত করে সফল হয়েছেন। অনেকবার ব্যর্থ হওয়ার পরেই সফল হয়েছেন। অনেক সংগ্রাম করে একটা জায়গায় এসেছেন। আমার ক্যারিয়ারের বয়স বেশি দিন না। মাত্র ১০ থেকে ১২ বছরের। আমার অভিনয়ের স্বীকৃতি আমি পেয়ে গেছি ‘অন্তরজ্বালা’ সিনেমা থেকে। মানুষ কিন্তু হল থেকে কেঁদে বের হয়েছে। একজন অভিনেতার অভিনয় দেখে যখন মানুষ কাঁদে, তখন মনে হবে, সে অভিনেতা হিসেবে সার্থক। এই দুই টার্মে আমি আরও কিছু সিনেমা করতে পারতাম, যদি আমি সিনেমা নিয়ে পড়ে থাকতাম। আমার ক্যারিয়ারে আরও কিছু ছবি যোগ হতো। সেটা অনেকখানি এই সংগঠনকে সামনে টেনে আনতে ক্যারিয়ার আড়ালে চলে গেছে। এটা আমার ক্যারিয়ারকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করছি। তারপরও কারও না কারও এগিয়ে আসতে হবে। যদি এটুকুই না আসতাম, ইন্ডিয়ান ছবির যে আগ্রাসন তৈরি হয়েছিল, যৌথ প্রযোজনার নামে যেভাবে একটা প্রতিষ্ঠান প্রতারণা শুরু করেছিল, অযাচিতভাবে বিদেশি শিল্পী আসা শুরু হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে কিন্তু এই ইন্ডাস্ট্রিই থাকত না। আমার কথা হলো, যদি ইন্ডাস্ট্রিই না থাকে, সিনেমা কীভাবে করব। কারও না কারও তো এগিয়ে আসতে হবে। যার কারণে সাহস করে সামনে এগিয়ে আসা। আসলে কিন্তু তখন আমার নির্বাচন করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার নিয়ে কী চিন্তা করছেন?
একটা পাণ্ডুলিপি রেডি ছিল। মালেক আফসারী পরিচালক। ছবির নাম ‘টেনশন’। গত এপ্রিলে শুটিং শুরু হওয়ার কথা। এই ছবিটা আমার ক্যারিয়ারে একটা মাত্রা যোগ করত। বছরে দশটা ছবির থেকে ছবির মতো ছবি একটা কি দুটো করলেই মানুষ মনে রাখে। অনেক দিন পরে ‘অন্তরজ্বালা’ দিয়ে আমি মানুষের মনের মধ্যে চলে এসেছি। কেউ দেখলেই চরিত্রের নাম ধরে বলে, এই যে আলাল ভাই যায়...। এ রকমই একটা সিনেমা করার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। এত দিনে শুটিং শুরু হয়ে যেত। কোরবানির ঈদের জন্য রেডি করছিলাম। এখন সেটা তো করোনার কারণে পিছিয়ে গেল। এখন চিন্তা হলো জীবন আগে। জীবন বাঁচলে সবকিছু করা যাবে। আমি আরও কিছু ছবি করব। ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দেব।