পাঁচ লাশ যেসব প্রশ্নের জবাব চায়

by
https://cdn.banglatribune.com/contents/cache/images/350x0x1/uploads/media/2018/01/30/b3e4db44b285b279119a8bbddece1b8e-5a7043f71563c.jpg
হারুন উর রশীদ

ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনে পাঁচ রোগীর মৃত্যু অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে হাসপাতালের কেউ কেন আগুন লাগার পর পাঁচ রোগীকে উদ্ধারের চেষ্টা করলেন না। আর গভীর রাতে তারা পাঁচজনকেই কেন করোনা রোগী বানানোর চেষ্টা করলেন। করোনা আক্রান্ত ছিলেন তো তিনজন।
আমি শুরু থেকেই ঘটনাটি ফলো করেছি। আর সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করেছি। আমার নানা প্রশ্ন আর সন্দেহ তখনই প্রবল হয়েছে যখন গভীর রাতে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লিখিত বিবৃতি দিয়ে পাঁচজনকেই ‘করোনা সন্দেহে ভতি’ বলেছে। আরও একটি লাইন আছে তাদের বিবৃতিতে। আর তা হলো, ‘সেই সময়ে আবহাওয়া খারাপ ছিল ও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বাতাসের তীব্রতায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভর্তি পাঁচজনকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি।’
এবার আমি কিছু তথ্য জানাচ্ছি-

১. গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারটি মূল ভবনের বাইরে জরুরি বিভাগের পাশে অস্থায়ীভাবে একমাস আগে করা হয়।
২.  এই জায়গায় আগে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো।
৩. সেন্টারটিতে পাঁচটি বেড এবং সামনে স্যাম্পল কালেকশনের জায়গা আছে।
৪. সেন্টারটি ২০ ফুট বাই ১০ ফুট আয়তনের।
৫. ছাদ টিনের। স্টিলের ফ্রেম। পার্টিশন ও সিলিং কাঠের বোর্ড দিয়ে তৈরি। জিপশামও ব্যবহার করা হয়েছে।
৬. বেডগুলো শক্ত কার্টেইন দিয়ে আলাদা করা।
৭.  এসি, ভেন্টিলেটর আছে। আছে আইসিইউ সুবিধা।

আমরা এরইমধ্যে আরও জেনেছি ওই হাসপাতালে কোনও ফায়ার ফাইটিং টিম নেই। আর ফায়ার ফাইটিং সরঞ্জাম যা ছিল তা মেয়াদোত্তীর্ণ। সেন্টারটির জন্যও আলাদা কোনও ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা ছিল না।

তাহলে আগুন লাগার পর কী ঘটেছিলো:

হাসপাতালের মূল ভবনে এক রোগীর করা ভিডিও থেকে এটা স্পষ্ট যে আগুন লাগে রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে। ফায়ার সার্ভিস খবর পায় রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে। তারা ১০ মিনিটের মধ্যেই আসে। রাত সাড়ে ১০টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচ রোগীর লাশ। ফায়ার সার্ভিসকে হাসপাতাল থেকে খবর দেওয়া হয়নি। পুলিশের ৯৯৯ এ খবর দেয় মূল ভবনের রোগীরাই। তাহলে হাসপাতালের লোকজন কী করেছেন?
ওই পাঁচ রোগী ছাড়া তখন আইসোলেশন সেন্টারে আসলে কেউ ছিলেন না। না নার্স, না কোনও চিকিৎসক অথবা কোনও ওয়ার্ড বয়। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের উদ্ধারের কোনও চেষ্টাই করেননি। ফায়ার সার্ভিস সেখানে গিয়ে সেই চেষ্টার কোনও আলামত পায়নি। ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলেও তা ব্যবহার করা হয়নি। পাঁচজন রোগী চিকিৎসার নামে অসহায় ও একাকী মারা গেছেন আগুনে। আর সেই দায় এড়াতেই ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ গভীর রাতে বিবৃতি দিয়ে বলে, ‘সেই সময়ে আবহাওয়া খারাপ ছিল ও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বাতাসের তীব্রতায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে  ভর্তি পাঁচজনকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি।’

সেটা কীভাবে সম্ভব হবে? একটি বিলাসবহুল ‘আধুনিক’ হাসপাতালে তো ফায়ার ফাইটিং টিমও নেই। কর্মচারীরাই নাকি একসঙ্গে সব কাজ করেন। আর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে তারা এখন বলছেন ফায়ার ফাইটিং টিমের প্রধান।
আইসোলেশন সেন্টারের নামে ‘অগ্নিকুন্ড’?

যুক্তিসঙ্গ কারণেই সেন্টারটিতে আইসিইউ থাকবে। ভেন্টিলেটর থাকবে। হাই ব্লো অক্সিজেন থাকবে। নেগেটিভ প্রেসারে এসি থাকবে। থাকবে নানা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। কিন্তু এরসঙ্গে স্থাপনাটিও হতে হবে ওই ব্যবস্থার উপযোগী। বিদ্যুৎ সিস্টেমও থাকতে হবে সুরক্ষিত। একটি হাসপাতালের আইসিইউ তো সবচেয়ে সুরক্ষিত  থাকে। তাই যদি হয় তাহলে হাসপাতালের পাশে বোর্ড কাঠের মতো সর্বোচ্চ দাহ্য বস্তু দিয়ে তারা কিভাবে আইসোলেশন সেন্টার করলো? কীভাবে আইসিইউ সেন্টার করলো? এই অগ্নিকুন্ড তৈরি করতে তারা স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি নিয়েছিল? হাসপাতালের বর্ধিত অংশ করতে কি অনুমতি লাগে না?

আসলে যেসব বস্তু দিয়ে আইসোলেশন সেন্টারটি করা হয়েছে তাতেই সেটা একটা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। আর মূল ভবন থেকে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া হয়। আলাদা কোনও বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়নি। ফলে আইসোলেশন সেন্টারের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের চাপ পড়ে মূল ভবন থেকে আনা বিদ্যুৎ লাইনের ওপর। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দাহ্য কাঠামোতে। আর ভেতরে রোগীদের জীবন শেষ করে দিয়েছে। জীবন বাঁচানোর সেন্টার পরিণত হয়েছে ডেথ সেন্টারে।

কেন এত নাটক?

করোনা আইসোলেশন সেন্টারটি বানানো হয় এক মাস আগে। কিন্তু ইউনাইটেড কোভিড হাসপাতাল নয়। সরকার সব হাসপাতালে আইসোলেশন সেন্টার করতে বলেছে করোনা রোগী সন্দেহ হলে যেন তাকে আইসোলেশনে রাখা যায়। আর পজেটিভ হলে যেন তাদের কোভিড হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তারা করোনা পজেটিভ রোগীদেরও চিকিৎসা দিচ্ছিল। কেন দিচ্ছিল? এই প্রশ্নে এখন তারা সরকারের দুই দিন আগের নির্দেশনাকে সামনে আনছে। কিন্তু  মাহবুব এলাহীর (৫০) ঈদের আগে দুইবার টেস্টে করোনা নেগেটিভ আসলেও তাকে আইসোলেশন সেন্টার থেকে ছাড়েনি। এমনকি বুধবার সারাদিন তার স্বজনরা হাসপাতালে ছিলেন তাকে নিয়ে আসার জন্য। শেষ পর্যন্ত তাকে কেবিনে স্থানান্তর করার অনুরোধও হাসপাতাল কর্তপক্ষ রাখেনি। আর রাতে সে আগুনে মারা গেলো। কেন তাকে ছাড়া হলো না? আর রিয়াজুল করিম লিটন ভর্তি হয়েছিলেন মাত্র একদিন আগে। তারও করোনা নেগেটিভ। তারপরও কেন হাসপাতালে রাখা হলো?
এখন বলা হচ্ছে সবাই নাকি লাইফ সাপোর্টে ছিল। রাতেই পুলিশ জানায় পাঁচজনের তিনজন পজেটিভ, দুইজন নেগেটিভ। কিন্তু গভীর রাতে ইউনাইটেড বিবৃতি দিয়ে বলল, পাঁচজনই সন্দেহজনক করোনা রোগী। কেন এটা করলো? মাহবুব এলাহীর লাশও তারা তার পরিবারকে প্রথমে দিতে চায়নি। চেয়েছিল করোনা রোগী হিসেবে দাফনের ব্যবস্থা করতে। শেষ পর্যন্ত ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে লাশ দিলেও দুইবার যে করোনা নেগেটিভ হয়েছে তার কাগজপত্র দেয়নি পুড়ে যাওয়ার অজুহাত তুলে।

এই সব নাটকের মধ্যে আসলে একটিই উদ্দেশ্য। আর তা হলো প্রমাণ করা যে তারা মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন। এমন অবস্থায় ছিলেন যে দ্রুত তাদের উদ্ধার করা যায়নি। তারা দাবি করছে সেন্টারে তখন চিকিৎসক নার্স ছিলেন। কী অবাক করা ব্যাপার তারা বের হতে পারলেন। তাদের কিছু হলো না। কিন্তু রোগীরা বের হতে পারলেন না। বের করা গেলো না। তারা মরে গেলেন!
পাঁচটি লাশ যেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়

১. এত হেলাফেলা করে কেন আইসোলেশন সেন্টার করা হলো? আর সেখানে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে কেন করোনার চিকিৎসা দেওয়া হলো?
২. কেন সর্বোচ্চ দাহ্য বস্তু দিয়ে সেন্টারটি বানানো হলো?
৩. কেন রোগীদের একা আইসোলেশন সেন্টারে রাখা হলো, ডাক্তার নার্স কেন ছিল না?
৪. আগুন লাগার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন উদ্ধারের উদ্যোগ নিল না?
৫. সেন্টারের জন্য আলাদা তো দূরের কথা পুরো হাসপাতালে কোনও ফায়ার ফাইটিং টিম কেন নেই? সরঞ্জাম কেন মেয়াদোত্তীর্ণ?
৬. হাসপাতাল কি পুড়িয়ে মারার জায়গা?
৭. মৃত্যুর দায় কে নেবে?
পাঁচ রোগীর আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আপনারাই বলুন এটা কি অপমৃত্যু?
লেখক: সাংবাদিক
ই-মেইল:swapansg@yahoo.com