সাংবাদিক মিজানের ওপর আর কত আক্রোশ?
by সোহরাব হাসানআমরা যারা ঢাকায় বসে সাংবাদিকতা করি তারা ভাবতে পারব না, মফস্বলের সাংবাদিকদের কতটা বৈরী পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। অপ্রিয় সত্য না লিখলে কোনো সমস্যা নেই। এ ধরনের অনুগত সাংবাদিকদের ক্ষমতাধরেরা খুবই পছন্দ করবেন। ইনাম-বকশিশ দেবেন। কিন্তু সত্য কথা লিখলেই নেমে আসবে চাপ, হুমকি, মামলা, জেল ও শারীরিক নির্যাতন।
সাংবাদিকদের ওপর কখনো স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন আবার কখনো রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হামলার খবর সংবাদমাধ্যমে আসে। অনেক সময় পুলিশ প্রশাসন বৈরী হলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহায়তার হাতে বাড়ায়। আবার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বৈরী হলে পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায়। অনেক সময় কোনোটাই পাওয়া যায় না।
গত এপ্রিলে জেলের চাল চুরিসংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করায় এক সাংবাদিককে মেরে রক্তাক্ত করেছিলেন ছাত্রলীগের এক কর্মী। এরপর ওই সাংবাদিক মামলা করলে পুলিশ ওই ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। করোনাকালে বিভিন্ন স্থানে অসাধু জনপ্রতিনিধিদের চাল চুরির ঘটনা ফাঁস করতে স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের পরস্পরকে সহায়তা করার খবরও আসছে।
কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও পুলিশ প্রশাসন যখন কোনো সাংবাদিকের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়, তখন তাঁকে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
সম্প্রতি প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি এ বি এম মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করার ঘটনাটি যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি নিন্দনীয়। গত সাত বছরে এটি তাঁর বিরুদ্ধে সপ্তম মামলা। অর্থাৎ ফি বছর তাঁকে একটি করে মামলার মুখোমুখি হতে হয়।
এর আগে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে যে ছয়টি মামলা হয়েছিল, প্রতিটিতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল পুলিশকে মারধরের মামলা। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ মামলাটি করা হয় একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মিজান মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন পেশাগত কাজে। একই পথে সাদাপোশাকে পুলিশের একটি টহল দল ফিরছিল। সড়কে যানজটের কারণে পুলিশের গাড়ি আটকে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের এক এএসআই মিজানুর রহমানকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। মিজান প্রতিবাদ করলে তর্কাতর্কি ও হাতাহাতি হয়।
তাঁরা কেউ কারও পরিচয় জানতেন না। পরিচয় জানার পর দুজনে একসঙ্গে বসে চাও খান। এরপর মিজান তাঁরই মোটরসাইকেলে করে এএসআইকে তাঁদের ফাঁড়িতে পৌঁছে দিতে গেলে সেখানে তাঁকে আটক করা হয়। পরে থানায় নিয়ে রাতভর নির্যাতন করে পুলিশ। এতে মিজান এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাঁকে আদালতে যেতে হয়ে অন্যের সাহায্যে—তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না। এই মামলায় তিনি ২ মাস ১৭ দিন তিনি জেলে ছিলেন।
পরে মিজানের বাবা হাইকোর্টে রিট করলে পুলিশ নিজেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়ে দেয় মিজান নির্দোষ। এই মামলার নেপথ্যেও একজন প্রভাবশালী নেতার হস্তক্ষেপ ছিল বলে অভিযোগ আছে। প্রথম আলোর ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধির কাছে তখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছিলেন, ওপরের চাপেই তিনি মামলাটি নিয়েছেন। কেবল চাঁদাবাজি নয়, মিজানের বিরুদ্ধে করা সব মামলার পেছনেই প্রভাবশালী নেতার হাত আছে।
উচ্চ আদালতের রুলনিশি জারির পর স্থানীয় পুলিশ এই বলে অঙ্গীকার করে যে তারা মিজানকে হয়রানি করবে না। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে আর কোনো মামলা হয়নি। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের অনিয়ম, দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলেই তাঁরা মিজানের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা ঠুকে দিতেন। তাঁরাও জানতেন, এসব মামলা টিকবে না। কিন্তু হয়রানি করার মোক্ষম অস্ত্র ছাড়ে কে? একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি বছরে একটি মামলা হয়, তাঁকে সব সময় দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। তিনি কাজ করবেন কখন?
স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণে মিজানের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করা হয় ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। এরপর ২০১৪ সালের ২৬ মে মামলা করেন শাহীন হাওলাদার। তাঁর দুর্নীতির খবরের শিরোনাম ছিল ‘বাউফলে স্থানীয় সরকার সহায়তা প্রকল্প কাগজে আছে, বাস্তবে নেই’। তৃতীয় মামলাটি করেন আলম সিকদার নামের এক আওয়ামী লীগের এক নেতা। সেটিও সরকারের খাসজমি নিজের দখলে রাখা নিয়ে। চতুর্থ মামলাটির কথা আগেই বলা হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাইতে দ্রুত বিচার আইনে তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়।
অতীতে কোনো মামলায় মিজানুর রহমানকে আটকাতে না পেরে এবারে হত্যা মামলা করা হয়েছে। অথচ গত রোববার যখন আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয় তখন তিনি ঘটনাস্থলে আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে পেশাগত দায়িত্বই পালন করছিলেন। সেই ভিডিও ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে। তার পরও তাঁকে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার বাদী নিহত তাপস কুমার দাসের ভাই পঙ্কজ কুমার দাস সাংবাদিক মিজানসহ অনেক আসামিকে চেনেনও না। তাঁকে প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে যেসব নাম দেওয়া হয়েছে, তাঁদেরই আসামি করা হয়েছে। সূত্রে প্রকাশ, আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছেন, ‘এবারে মিজানকে দেখে নেব।’ আওয়ামী লীগের ওই নেতার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার কারণে তাঁকে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপই একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ এনেছে। কাদের অভিযোগ সত্য, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে আশা করি। কিন্তু যিনি সাংবাদিক হিসেবে ঘটনাস্থলে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাঁকে আসামি করা হয়েছে পুরোনো আক্রোশ থেকে।
পটুয়াখালীর সাংবাদিক নেতারা মিজানকে হত্যা মামলায় জড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাংবাদিকের কোনো দল বা গ্রুপের প্রতিহিংসার শিকার হওয়া স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর বড় হুমকি।
এই হুমকি, হয়রানি ও মামলার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সত্য প্রকাশ থেকে সাংবাদিককে দূরে রাখা। টিভির খবরে দেখলাম, নরসিংদীতে এক ইউপি চেয়ারম্যানের চাল চুরি নিয়ে খবর প্রচার করায় এসএ টিভির প্রতিনিধি সজল ভূঁইয়াকে বেদম প্রহার করেন তাঁর লোকজন। এতে সজল ভূঁইয়া এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে?
বাউফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যুবলীগের এক কর্মীর খুন হওয়ার ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক। নষ্টভ্রষ্ট রাজনীতির শিকার তাঁরা। তাপস কুমার দাস হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। অপরাধীরা শাস্তি পাক। তাই বলে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে জড়ানো হলো কেন? অবিলম্বে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক।
সাংবাদিকের কাজ হলো ভয় ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে সত্য প্রকাশ করা। মিজানুর রহমান সেটি করে চলেছেন। আমরা বলব, যতই বাধা আসুক, আপনি সাহস হারাবেন না। সহকর্মী হিসেবে আমরা আপনার পাশে আছি। প্রথম আলো আপনার পাশে আছে। সত্য আপনার পাশে আছে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com