সীমিত পরিসরে লিখছি
by আনিসুল হকবিভাগীয় সম্পাদক ফোনে আদেশ করেছেন, পরিসর বড় সীমিত, ৭০০ শব্দের মধ্যে লেখা সীমিত রাখবেন। আমি বলি, আমাদের লেখার পরিসর যে ক্রমে কমে আসছে, আলো ক্রমে কমিতেছে, সে–ও কি আর বলে দিতে হবে। সীমিত পরিসরেই লিখব। আমার সীমিত ঘাড়ের ওপরে বেঢপ বড় আকারের হলেও সীমিতসংখ্যক একটাই মাথা।
সীমিতই তো আমাদের পরিসর। মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল। ১৬ কোটি মানুষ। এক বর্গমাইলে ১ হাজার ১৪৬ জন এখানে বসবাস করে। ভারতে প্রতি বর্গমাইলে বাস করে ৩৮৬ জন। ওদের জনঘনত্ব আমাদের ৩ ভাগের ১ ভাগ। চীনের জনঘনত্ব ১৪২। আমাদের ৯ ভাগের ১ ভাগ। আমেরিকায় প্রতি বর্গমাইলে বসবাস করে ৮৪ জন। আমাদের চেয়ে সীমিত পরিসরে আর কে থাকে?
আমাদের ঢাকার লালবাগ থানায় প্রতি বর্গমাইলে বাস করে ১ লাখ ১৩ হাজার মানুষ। এত মানুষ, এত মানুষ। নিজের পা চুলকাতে শুরু করলে পাশের জন আরাম পায়। নিজের পেট গুড়গুড় করলে পাশের জন নিজের পেটে হাত দেয়। নিজের চোখে চশমা পরলে একটা ডাঁটি আরেকজনের কানে গিয়ে বসে।
আমরা ১০ ফুট বাই ৬ ফুট ঘরে ঘুমাই ১০ জন। কবীর সুমনের গান আছে দশ ফুট বাই দশ ফুট। সেখানে ঘুমায় ৪ জন। তবে আরেকজন আসছে। আরেকজন আসছে, কারণ, উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। সুমন লিখেছেন:
খাওয়া–বসা–ঘুম একই জায়গায়
ছেলেমেয়ে দেখে আধো তন্দ্রায়
বয়স্ক দুই দেহ মিলে যায়
আঁধার ঘনালে ঘুটঘুট।
আমাদের পরিসর নেই। আমাদের স্পেস নেই। আমাদের জমি নেই। আমাদের আকাশ নেই। আমাদের রোদ নেই। আমাদের বন নেই। আমাদের নদী নেই। আমাদের বাতাস নেই। কিন্তু আমরা আছি। ষোলো কোটি। আমাদের সবকিছুই তাই সীমিত পরিসরে।
আমরা সীমিত পরিসরে মাতৃগর্ভে থাকি। আমাদের বাল্যবিবাহিত মায়েরা অপুষ্টির পেটে বড় কষ্ট করে আমাদের ধারণ করেন। তারপর সীমিত পরিসরের আঁতুড়ঘরে গোয়ালের এক কোণে ভাঁড়ার ঘরের পাশে আমরা ভূমিষ্ঠ হই। সীমিত পরিসরে স্তন্য পান করা শেষ করার আগেই আবার ট্যাঁ–ফোঁ। আরেকজন এসে সেই দুগ্ধে ভাগ বসায়। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিই স্থান। পরিসর কমতে থাকে। আমরা সীমিত পরিসরে খাই, সীমিত পরিসরে ঘুমাই, সীমিত পরিসরে দৌড়াই, সীমিত পরিসরে স্কুলে–মাদ্রাসায় যাই, সীমিত পরিসরে শিক্ষকেরা এসে সীমিত পরিসরে পড়ান, সীমিত পরিসরে ঝরে যাই, কিংবা পিএসসি পরীক্ষায় সীমিত পরিসরে লিখে সীমিত পরিসরে পাসও করে যাই। করি বা না করি, কারখানায় গিয়ে সীমিত পরিসরে গনগনে লোহার পাশে, কিংবা চোখধাঁধানো আলোর নিচে উদয়াস্ত কাজ করতে থাকি। ঘামে–গরমে গলে বাড়ি ফিরে ৬ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে ১০ জনে মেস করে থাকি। আমার জামা ও ধার নেয়, ওর শেমিজ আমি পরে সীমিত দেহের পরিসরখানা ঢাকি, সাজাই।
কী করব! আমাদের তো শুধু ঘরের পরিসর সীমিত নয়, আমাদের সাধ্যের পরিসরও যে বড় সীমিত। ‘নীড় ছোট ক্ষতি কী, আকাশ তো বড়’ গান শুনলে সীমিত পরিসরে অভিমান হয়, আমাদের যে আকাশও নেই। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে’—এই গানের অর্থও আমাদের কাছে একটাই: যেকোনো দিন ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে হারিয়ে যেতে পারব!
আমাদের রাজধানীর রাস্তাঘাট সীমিত পরিসরের, সু্যয়ারেজ সিস্টেম সীমিত পরিসরের, গণপরিবহন সীমিত পরিসরের। একটা ৬ ফুট বাই ৪ ফুট টেম্পোতে আমরা উঠি ১৪ জন। তবে ভারতীয়দের মতো একটা স্কুটিতে ছাগল, বাক্সপেটরা, মুরগিসমেত ১৭ জন ওঠার রেকর্ড অবশ্য আমরা ভঙ্গ করতে পারিনি।
আমাদের সীমিত পরিসরের ফেরিতে আমরা উঠি ১২ হাজার, তবু ফেরি ডোবে না। লঞ্চ বরং অতি-অভিমানী, প্রায় তারা ডুবে যান, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ তারা নিতে চান না। আমাদের সীমিত পরিসরের রেলগাড়ির ছাদে আমরা উঠি অযুত–নিযুত। অবস্থা এমন হয় যে চাকা ঘোরে, কিন্তু মানুষের ওজনের চাপে রেলগাড়ি এগোতে পারে না, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করে চাকার ঘর্ষণের আওয়াজ তোলে।
আমাদের পরিসর সর্বদাই সীমিতই ছিল, আছে, থাকবে। আমাদের রোগে–শোকে আমরা সরকারি মেডিকেলের বারান্দায় ২ ফুট বাই ৫ ফুট জায়গা পাই, যদি ময়মুরব্বির দোয়া বলবৎ থাকে।
আমাদের স্বপ্নের পরিসরও সীমিত। আমাদের কবরস্থানের পরিসরও সীমিত হয়ে আসছে। তবু একটা জিনিস এখনো হয়নি, কোনো এক দেশে নাকি লাশ খাড়া করে রেখে কবর দেয়, আমাদের এখনো তা করতে হচ্ছে না।
তাই বলি, খুলে দিন। সীমিত পরিসরেই খুলে দিন। আমরা সীমিত পরিসরে বেঁচে আছি, বেঁচে আছি কি নেই, তা–ও জানি না। এবার সীমিত পরিসরে মরতে শুরু করেছি, সেখান থেকে যদি আমাদের অসীমের দিকে যাত্রা শুরু হয়, তবে একটিবার, অন্তত একটিবার তো আমরা সীমার বাইরে যেতে পারব।
জন্মেছি সীমিত পরিসরে (অসীমিত হারে), প্রতিটা দিন কাটিয়েছি সীমিত পরিসরে, মৃত্যুর কালে অন্তত সীমাটা ছাড়াই। জগৎ দেখুক, শাবাশ বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক