https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2020/05/28/e45a0038aa9deca7fd9b5bfaa3698b59-5ecfdafe30d75.jpg
তাজিংডংয়ের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

তাজিংডং বিজয়ের স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফেরা

by

স্থানীয় উপজাতীয়দের ভাষায় ‘তাজিং’ শব্দের অর্থ বড় এবং ‘ডং’ শব্দের অর্থ পাহাড়। এই দুটি শব্দ থেকে তাজিংডং পর্বতের নামকরণ। সরকারিভাবে তাজিংডং বিজয় পর্বত। তাজিংডং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী পাংশা ইউনিয়নে সাইচল পর্বতসারিতে অবস্থিত। এটি রুমা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। তাজিংডং পর্বতের উচ্চতা ১ হাজার ২৮০ মিটার (কারও মতে ৪ হাজার ১৯৮ দশমিক ৪ ফুট, কারও মতে ৪ হাজার ৩০০ ফুট)।

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে রাত ১১টার বাসে উঠলাম। যানজটহীনভাবে ঢাকা পার হয়ে মধ্যরাতে হাইওয়ের কোনো এক রেস্তোরাঁয় বাস থামল খাবারের জন্য। ক্ষুধা নেই, প্রচণ্ড দামের কারণে এক কাপ কফি ছাড়া কিছুই খেলাম না। কিছুক্ষণ পর বাস আবার তার আপন গতিতে চলা শুরু করল। আশপাশের সঙ্গীরা সবাই ঘুমে। আমি পুরো রাস্তাটা উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকলাম।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় বান্দরবানে পৌঁছালাম। নেমে চা-টা খেয়ে অটোতে করে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। সেখান থেকে থানচি বাসস্ট্যান্ডে ফিরে সকাল আটটার বাসের টিকিট কেটে ফেললাম। পুরো বাসে ৯০ শতাংশ যাত্রী আদিবাসী। তাঁদের সঙ্গে ভ্রমণ করছি, সে ছিল এককথায় অসাধারণ। পুরো রাস্তায় তাঁদের সঙ্গে গল্প করে সময় কেটে গেল। 

ঠিক সময়ে বান্দরবান থেকে বাস ছুটছে অপরূপ সৌন্দর্যে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে ওপরের দিকে। কখনো আকাশের দিকে উঠতে থাকে তো আবার কখনো নিচে নামতে থাকে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ের বাঁকে খুব সামনের পথও দেখা যায় না। মনে হয়, এই বুঝি পাহাড়ের খাদে পড়ে যাচ্ছি। এই জার্নিটা ঠিক রোলার কোস্টার রাইডের মতো অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর। সারা জীবন আপনাকে মনে রাখতে বাধ্য করবে। পাহাড় কেটে বানানো রাস্তা নিচের দিকে তাকালে গা ছমছম করে, এতটা নিচে যে আর দেখা যায় না মেঘের কারণে। পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়গুলো মেঘের চাদরে ডাকা, মেঘ পাহাড়ের সেকি অলিঙ্গন। আল্লাহ তাআলার কি অপরূপ সৃষ্টি৷ চিম্বুক পাহাড়ের সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের পাশে যাত্রাবিরতি৷ যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কেউ কেউ আবার হালকা নাশতাও করে নিল।

থানচি নামের রহস্য
১৮২৪ সালে বার্মা-ব্রিটিশ যুদ্ধের পর থানচি উপজেলা আরাকান ব্রিটিশ-ভারতের প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে থানচি ও এর প্রতিবেশী অঞ্চলে আরাকানদের অভিবাসন সহজ হয়। অভিবাসীরা এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে এবং ১৯০০-এর রেগুলেশন-১ (পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল) এদের স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি দেয়। মারমা শব্দ থাইন চৈ বা বিশ্রামের স্থান থেকে থানচি নামটির উৎপত্তি। ধারণা করা হয়, ১৯৫০ সালে বা তার আগে নৌপথে চলাচলের সময় যাত্রীরা বিশ্রামের জন্য এ স্থানে থামত বলে থাইন চৈ নামে স্থানটি পরিচিত ছিল, পরে তা থানচি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বান্দরবান সদর থেকে থানচির দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার। এ উপজেলার উত্তর-পূর্বে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা, উত্তরে রুমা উপজেলা, পশ্চিমে লামা উপজেলা, আলীকদম উপজেলা ও দক্ষিণে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ এবং পশ্চিমে মিয়ানমারের চীন প্রদেশ অবস্থিত।

দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা পর দুপুর ১২টার দিকে পৌঁছে গেলাম থানচি বাজারে। বাজারে পশ্চিম পাশেই রয়েছে সাঙ্গু নদী। অবাক করা তার স্রোত। কিছু দূরেই পাহাড়ি মেয়েরা গোসল করছে, বাচ্চাগুলো তাদের সঙ্গ দিচ্ছে এবং যুবক ছেলেরা ভলিবল খেলছে। আর সাঙ্গু নদীতে রয়েছে শত শত অস্থির নৌকা। অদূরে দেখা যাচ্ছে ডিম পাহাড়। থানচি বাজারে পাহাড়িদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি রয়েছে শহরের জিনিসগুলো। হোটেলে রুম ঠিক করে জামা-কাপড় ছেড়ে গোসল করলাম। তারপর দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি। কারণ, পাহাড়িদের সরল জীবনযাপন দেখার খুব শখ। সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরে এক ঘুম। কারণ, পরদিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে দীর্ঘ ট্রেকিং। যার জন্য অগণিত দিন স্বপ্ন দেখছি।

https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2020/05/28/4ed64416a286b855cf892f34e22212d2-5ecfdafe00ef8.jpg
সমতল থেকে ৪ হাজারের বেশি ফুট ওপরে ওঠার পর বাংলাদেশের পতাকা হাতে। ছবি: সংগৃহীত

রাতেই গাইড দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে আগামী কয়েক দিনের জন্য হালকা খাবার কিনে নিলাম। সকালের খাবারও খেলাম।

সকাল ৯টায় স্বপ্নের তাজিংডং যাত্রা শুরু হলো আমাদের। একজন গাইডসহ আমরা ছিলাম ৬ জন। বাজার পার হয়েই অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ রোমাঞ্চকর পাহাড়ি পথে হাঁটা পথ শুরু। বোকার মতো নাশতায় গরুর মাংস খাওয়ার কারণে কষ্ট আরও বেশি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল প্রাণটা এখনই বের হয়ে যাবে, আর মাথার ওপর সেদিন সূর্য মামা মনে হয় রেগে ছিল। গরমে সবাই হাঁসফাঁস করছিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পরই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ, হাঁটছি আর হাঁটছি। নেই কোনো তার সীমানা। কী ভয়ংকর সেই পথ! একবার নামছি তো আরেকবার উঠছি। আর ভাবছি এইখান থেকে কি আমি ফিরে যেতে পারব সুস্থভাবে? মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল, জীবন মনে হয় এখানেই শেষ। পরক্ষণেই তাজিংডং যে আমাকে পৌঁছাতে হবেই, সেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে আবার হাঁটছি। একটার পর একটা পাহাড় সামনে আসছে, একটা অতিক্রমের পর আরেকটা পাহাড় আসছে। কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিচ্ছি। এভাবেই সময়গুলো কেটে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর একটা ঝরনা দেখলাম, সবাই যে যার বোতলে পানি ভরে নিল। কেউ কেউ শুকনো খাবার খেল। কেউ কেউ আবার গোসলে নেমে গেল, আমি শুয়ে নির্মল বাতাস খেতে লাগলাম আর গাইড দাদা হাত দিয়ে মাছ ধরতে নেমে গেল।

এই জায়গাগুলো এত সুন্দর! পথে পড়ল বিশাল বিশাল খাড়া সাঁকো। একটু পা হড়কালেই মৃত্যু নিশ্চিত। রাস্তায় নেই কোনো মানুষ। হঠাৎ সামনে পড়ল কমপক্ষে ৬০ ফুট খাড়া নিচু একটি পথ। কী মারাত্মক পথ! সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর বেলা আড়াইটায় পৌঁছলাম মুড়ংদের বোডিং পাড়ায়। বোডিং পাড়ায় অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। কেউ কেউ আবার দোকানের মধ্যেই শুয়ে পড়ল এবং সবাই হালকা খাওয়াদাওয়া করলাম। সম্পূর্ণ পাড়া ঘুরে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মুড়ং যুবকদের সঙ্গে আড্ডা বেশ উপভোগ্য। আর বোডিং পাড়ার পশ্চিম পাশ দিয়েই বয়ে গেছে পাহাড়ি কোনো ঝরনা থেকে পানির বহমান ধারা।

গাইড এখানে আবার গোসল করে নিল। বিশ্রাম নিয়ে অবশেষে আবার হাঁটা শুরু করলাম। প্রথম ৪০ মিনিট শুধু পাহাড়ের ওপরেই উঠতে থাকলাম। কী সেই কষ্ট! মনে হচ্ছিল যেন আগুনের ভেতর হাঁটছি। একবার ওপরে উঠছি, আরেকবার নামছি, আরেকবার উঠছি। মনে হচ্ছিল একজন শিল্পী তাঁর শিল্পীর তুলিতে রাস্তাগুলো এঁকেছেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বোমদের শেরকর পাড়ায় পৌঁছলাম। সবাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিলাম। আজ আমাদের থাকার জায়গা হলো পাহাড়িদের তৈরি বাঁশের ঘরে। ফ্রেশ হয়ে আসার সঙ্গেই রং–চা। আহ্‌! স্বাদটা এখনো জীবন্ত। তারপর কয়েকজন গেল স্থানীয়দের সঙ্গে কাঠবিড়ালি শিকার করতে। তারা যখন ফিরল, তখন গেলাম শেরকর পাড়ার সর্বোচ্চ জায়গায়। গানের আড্ডায় আমাদের রাতটা হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সেরা রাত। ওই দিন ছিল পূর্ণিমা। মনে হচ্ছিল প্রকৃত আমাদের জন্যই নতুন করে সেজেছে। কথায় আছে, ‘প্রকৃতি কখনো কাউকে নিরাশ করে না’। আড্ডা দিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে এক প্রশান্তির ঘুম।

ভোর সাড়ে ৪টায় উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কারণ, আমাদের উদ্দেশ্য, তাজিংডংয়ে বসে সূর্যোদয় দেখা। ৫টার সময় রওনা দিলাম। অন্ধকারে লাইট ধরে ধরে ট্রেকিং। সঙ্গে ছিল শত শত আশা। শুধু ওপরে উঠছি আর উঠছি। তাজিংডংয়ের যত কাছে যাচ্ছি, ততই শিহরিত হচ্ছিলাম। দীর্ঘ ট্রেকিং শেষে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের তাজিংডংয়ের চূড়ায়। যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। অনুভূতি প্রকাশের ভাষা জানা নেই। উঠেই দেখলাম সূর্যোদয়। আর চারপাশে মেঘের আনাগোনা। মনে হচ্ছিল মেঘের মধ্যে একটা ঘর থাকলে মন্দ হতো না! তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল—
‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ, কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না,
যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না’

তাজিংডংয়ের চূড়ায় উঠে একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাইলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৩০০ ফুট ওপরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়ে আমরা তখন। তাজিংডংয়ের চূড়া থেকে সাকা হাফং পর্বত দেখা যায়। সাকা হাফং পর্বতের এক পাশে বাংলাদেশ, আরেক পাশে মিয়ানমার। তাজিংডংয়ের চূড়ায় বসে আমার ‘জান্নাত’ প্রিয় মাকে ফোন দিলাম।

এবার যান্ত্রিকতার শহরে ফেরার পালা। এক আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর, অদ্ভুত, চমৎকার তৃপ্তি নিয়ে ফিরছিলাম। আর একটা কথা ভেবে শান্তি পাচ্ছিলাম যে আমি সবার সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে গিয়েছি এবং সবার আগে তাজিংডং বিজয় করেছি। এত প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে তাজিংডং বিজয়ের স্বাদ নিয়ে তবেই আমি বাড়ি ফিরছি!
*লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়