https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2020/05/29/d58e30281381bb74d8a4cc5bc739795b-5ed086b5a95eb.jpg
সন্‌জীদা খাতুন ও আনিসুজ্জামান। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সন্‌জীদা খাতুনের বই শান্তিনিকেতনের দিনগুলি নিয়ে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে ছিলেন তাঁরা, ২৬ নভেম্বর ২০১৯। ছবি: অন্য আলো
শ্রদ্ধা

আনিসুজ্জামান

by

প্রয়াত হয়েছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বরেণ্য গবেষক, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁকে কৈশোরকাল থেকে চিনতেন আমাদের বুদ্ধিবৃিত্তক ও সাংস্কৃতিক জগতের আরেক কৃতী সন্‌জীদা খাতুন। এ লেখায় তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন আনিসুজ্জামানকে নিয়ে

যখন স্কুলে পড়ি, তখন একটি কিশোর ছেলে ফজলুল হক হলের গেস্ট হাউসে আমাদের কাছে আসত। তার হাতে একতাড়া কাগজ থাকত। প্রুফ দেখাতে আসত সে আব্বুকে। আব্বু, কাজী মোতাহার হোসেন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতার কাল থেকে। সাহিত্য সংসদেরই ছাপাছুপির কাজে ওই আনাগোনা।

ফজলুল হক হলের হাউস টিউটরস কোয়াটারে এসে বারান্দার দরজায় ঘা দিলে আমি গিয়ে তার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে আব্বুর কাছে পৌঁছে দিতাম। দু-এক দিন বাদে প্রুফ দেখা হয়ে গেলে ছেলেটি আবার এসে সেগুলো ফেরত নিয়ে যেত। তখন থেকেই তার নাম জানতাম— ‘আনিসুজ্জামান’। সে-ও তখন স্কুলেরই ছাত্র।

 আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় আনিস এসে বাংলায় প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল। চুয়ান্ন সালের কথা। আনিস আমার চেয়ে দু-বছরের জুনিয়র ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা-মেয়েরা পরস্পর কথা বলতে পারবে না বলে নিয়ম থাকাতে ওর সঙ্গে কথাবার্তা হয়নি সেই সময়ে।

পরীক্ষার জন্য প্রশ্নোত্তরের নোট তৈরি করে পড়ার অভ্যাস ছিল না আমার। পরীক্ষার হলে বসেই প্রশ্ন অনুয়ায়ী উত্তর লিখতাম। বাংলা অনার্সে এক বছরের জুনিয়র সাবেরা খাতুন (পরে মুস্তাফা) তাই আমার কাছ থেকে নোটের সাহায্য পায়নি। আনিসও না। সে তো আমার কাছে চায়ওনি। নিজেই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে খুব গুছিয়ে পড়াশোনা করত আনিস। ছাত্রী অবস্থায় কাপ্তান বাজারের ওদিকে আনিসদের বাসায় গিয়েছিলাম একবার। তখনই ওর গোছানো পড়ার ধরনের কথা জেনেছিলাম। পরীক্ষার বহু আগেই প্রশ্নোত্তর লিখে তৈরি হয়ে গিয়েছিল সে।

চাকরিজীবনে আনিসের সঙ্গে ঠিকমতো আলাপ-পরিচয় হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মোটর দুর্ঘটনায় পড়ে দৈহিক-মানসিকভাবে আহত আনিসকে ওর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে দেখতে গিয়েছিলাম। ওর স্ত্রী বেবী খানিক পরপর বৈঠকখানায় শুয়ে থাকা স্বামীকে দেখে যাচ্ছিল, ফল কেটে এনে যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল। পরেও দেখেছি, এই সুশীলা স্ত্রী আনিসের নির্বিঘ্ন লেখাপড়া আর কাজকর্মের কতখানি সহায় ছিল।

আনিসের স্বভাবের বড় গুণ ছিল, তার নিশ্ছিদ্র সৌজন্য। কারও সঙ্গে ব্যবহারে কোনো অবস্থাতেই তাকে সৌজন্যবোধ হারাতে দেখিনি। তার কোনো কোনো ছাত্র সহকর্মী হওয়ার পর গুরুর সম্মান বজায় রেখে চলেনি সব সময়। আনিস পরম সৌজন্যভরে সে রকম পরিস্থিতির পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মারপ্যাঁচে চাকরিতে আনিসের ছাত্ররাও কেউ কেউ তার সিনিয়র হয়ে গিয়েছিল। সেই দেমাকে বিভাগীয় সভাতে বসে গলা উঁচিয়ে বলত, ‘আনিসুজ্জামান তো আমার জুনিয়র।’ আনিস স্বাভাবিক ভদ্রতাবশে ছাত্রের ঔদ্ধত্য অগ্রাহ্য করত।

আনিসের সিনিয়রিটি হারানোর ঘটনাটি একটু খুলেই বলি। দুর্ভাগ্যবশত ঘটনাক্রমে আমি নিজেও চাকরিতে জুনিয়র হয়েও শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সিনিয়র হয়ে গিয়েছিলাম।

উনসত্তর সালে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার পদে যোগ দিয়েছিল। তারপর সম্ভবত চুরাশি সালে ঢাকার বাংলা বিভাগে একটি প্রফেসর পদের জন্য বিজ্ঞাপন বের হলে আনিস সেই পদের জন্য আবেদন করে।

এদিকে তত দিনে বিভাগে আরও তিনজনের পদ পুনর্বিন্যাস (রি-স্ট্রাকচারিং) হয়ে প্রফেসর হওয়ার সব শর্ত পূরণ হয়েছে। একজনের পদ পুনর্বিন্যাস হয়ে গেল ঝটপট। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ আর আমার পদের পুনর্বিন্যাস আর হয় না। নানা ছুঁতোয় দেরি হতে থাকে। আনিসুজ্জামান আমাদের সিলেকশন বোর্ডের অন্যতম সদস্য জেনে আমি তাকে একটা চিঠি লিখি। তাতে লিখি যে বয়ঃকনিষ্ঠ হুমায়ুন আজাদ রি-স্ট্রাকচারিংয়ের দেরি দেখে ক্ষুব্ধ হচ্ছে, আমার নিজের জন্য নয়, তার জন্যই এই পুনর্বিন্যাস কাজটি তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার। যা হোক, তারপর একসময়ে পদবিন্যাস হয়ে যায়।

সিন্ডিকেট সভার অনুমোদন হলেই চাকরিরত আমাদের প্রফেসর পদের নিয়োগ কার্যকর হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী আমাদের অবেক্ষাকাল হলো এক বছর। এটা ছিয়াশি সালের কথা। বিজ্ঞাপিত প্রফেসর পদে আনিসের নিয়োগ সিন্ডিকেটে পাস হলেও নিয়ম অনুয়ায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড় নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তার কিছু দেরি হয়ে গেল। তদুপরি নতুন নিয়োগ অনুযায়ী তার অবেক্ষাকাল হলো দুবছর। কাজেই ভালো রকম জুনিয়র।

মজার ব্যাপার এই, আমাদের নির্বাচন বোর্ডের সদস্য হয়েও পাকেচক্রে আনিস হয়ে গেল আমাদের জুনিয়র। ফলে বিভাগীয় চেয়ারম্যান হওয়ার ক্ষেত্রেও আনিসের সময় এল আমাদের সবার পরে। একাডেমিক কমিটির সভায় আনিস জানাল, সে চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী নয়। আমাদের বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়রজন, আনিসের এই প্রত্যাখ্যান বিষয়ে প্রকাশ্যে কটূক্তি করলেন। আনিস নীরবে সরে গেল সেখান থেকে।

দেশের যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আনিস কখনো পিছপা হয়নি। ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে সে স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ় কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইন যখন তাকে এত অপদস্থ করল, তখন তার দিক থেকে টুঁ শব্দটি শোনা গেল না। আনিসের মৃত্যুতে আমরা জাতির বিবেককে হারিয়েছি মনে হয়। বড় হতাশ লাগে।