স্মরণ
দুর্যোগ ও জয়নুল
by সৈয়দ আজিজুল হকদুর্যোগ-দুর্বিপাকে আমাদের মনে পড়ে জয়নুল আবেদিনের চিত্রকলার কথা। গতকাল ছিল এ শিল্পীর মৃত্যুদিন
যে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতেছিলেন জয়নুল আবেদিন, তার মূল অনুপ্রেরণার বিষয় ছিল মানুষ।—মানুষের সুখ–দুঃখের জীবন, তার আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে যে জীবন। মানবমুখিতা বা জীবনমুখিতাই তাঁকে প্রকৃতিলগ্ন করেছে, করেছে দেশলগ্ন। এই মানুষ মানে ব্রাত্য নিম্নবর্গের মানুষ, শ্রমশীল আর সংগ্রামশীল মানুষ; পরিশ্রমবিমুখ পরশ্রমজীবী নয়। মানুষের দুর্দশা-দুর্ভোগ-দুর্যোগ তাঁর অন্তর্গত সত্তাকে যেমন বেদনার্ত করেছে, একইভাবে তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তাকে করেছে উজ্জীবিত, সক্রিয়। এই যে তাঁর জীবন–অনুধ্যান এর মধ্যে তিনি চেষ্টা করেছেন প্রকৃত প্রাণরসের সঞ্চার ঘটাতে। বাহ্যিক রূপের যথাযথতার প্রতি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণমূলক দৃষ্টি তো তাঁর ছিলই, কিন্তু তাকে অতিক্রম করে ওঁর দৃষ্টিশক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল অন্তর্গত সৌন্দর্যের প্রতি। ফলে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম এত বেশি প্রাণস্পর্শী হতে পেরেছে।
তেতাল্লিশের মন্বন্তরে দুর্যোগক্লিষ্ট মানুষগুলোর প্রতি পরম মমতা ও একাত্মতা বোধ করলেন জয়নুল। আর এরূপ আত্মীয়তা বোধ থেকে তাদের নিষ্প্রাণ ক্ষুৎপীড়িত অবয়বের হৃদয়স্পর্শী হাহাকারকে পরিস্ফুট করে তুলতে সক্ষমও হলেন তিনি। এই দুর্বিপাকের ঘটনায় সমাজমুখী হয়ে উঠল শিল্পীর মানবমুখী শিল্পচিন্তা। এই সমাজমুখিতাই তাঁকে ক্রমশ দেশমুখী করেছে। কল্যাণব্রতী করেছে। ব্যক্তিশিল্পীর সার্থকতার চেয়ে একটি পুরো জাতির পুরো জনগোষ্ঠীর শিল্পের বিকাশসাধনে নিবিষ্ট করেছে। ১৯৪৭–উত্তরকালে তিনি ঢাকায় যে শিল্প–শিক্ষালয় গড়ে তুললেন, তা এইরূপ মনোভাবেরই ফল। সমগ্র দেশের সত্তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলার নিবিড় আকাঙ্ক্ষার পরিণাম।
১৯৭০ সালে ফিলিস্তিনি জনগণের লড়াইয়ের চিত্র আঁকার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের চারটি দেশ সফরের ঘটনা কিংবা একই বছর বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক লাখ লোকের প্রাণহানির ঘটনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে চিত্র অঙ্কন—সবই তাঁর দেশাত্মবোধ ও বিশ্বাত্মবোধের ফল। তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মস্পৃহার মধ্যে এই কল্যাণকামী বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সে কাজ প্রতিষ্ঠান গড়া হোক, শিল্পী তৈরি করা হোক কিংবা হোক শিল্পকর্ম সৃষ্টি—সর্বত্রই তিনি মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ।
নিজের কল্যাণকামী চিন্তাকে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করতেও সক্ষম হয়েছেন। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে আজ করোনাক্রান্ত কালেও দেখি, তাঁরই গড়া প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ডিনের নেতৃত্বে চলছে চিকিৎসকদের সুরক্ষা সরঞ্জামাদি তৈরির কর্মযজ্ঞ, চলছে ত্রাণতৎপরতা। আর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ময়নুল আবেদিন পিতার ফিলিস্তিন সফরের সময় আঁকা একটি ছবি বিক্রি করে মানবতার সেবায় উৎসর্গ করতে উদ্যত। সত্তরের মে-জুলাই মাসে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের লড়াই দেখতে জয়নুল যে চারটি দেশ সফর করেন, তা শুরু ও শেষ হয়েছিল মিসর দিয়ে। মিসরের জীবনযাত্রা নিয়ে ১১ মে তারিখে আঁকা এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জয়নুলের একটি ছবি—যেখানে তাঁর তুলির বলিষ্ঠ টান অসাধারণভাবে পরিস্ফুট—পিতার ওই ছবিটি নিয়েই আজকের দুর্যোগকালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর পুত্র। এই পুত্রের জীবনদৃষ্টি ও এই চিত্র উভয়ই জয়নুলের সৃষ্টি; উভয়ই এই দুর্যোগে মানবকল্যাণে উৎসর্গিত। এখানেই জয়নুলের সার্থকতা।
মানুষ যেমন নিঃসঙ্গ, তেমনি একই সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের শত বন্ধনেও জড়িত। এই বন্ধনের সঙ্গেই সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রশ্নটি যুক্ত। মানুষ যত বেশি এই দায়িত্ব অনুভব করে, পালন করে, সে জন্য ত্যাগ স্বীকার করে, তত বেশি সে মহৎ হয়ে ওঠে। জয়নুলের মধ্যে আমরা এই মহত্তর জীবনবোধের পরিচয় পাই। যে কারণে দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তাঁর শিল্পচিন্তা, জীবনদর্শন ও ছবি আমাদের প্রাণিত করে।
সত্যের সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ক, আর সুন্দরের সঙ্গে সম্পর্ক কল্যাণের—এটি ছিল জয়নুলের দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর শিল্পদর্শনের মূলকথাও এটাই। এই আদর্শের কারণেই দুর্যোগ–দুর্বিপাকে মানবকল্যাণের প্রশ্নটি সবচেয়ে প্রত্যক্ষতা লাভ করে তাঁর জীবনে। শিল্পের শিল্পত্ব রক্ষা করেই মহৎ শিল্পীকে এই কল্যাণধর্মে নিয়োজিত হতে হয়। জয়নুল এটা করেছেন অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে। ‘শিল্পাচার্য’ উপাধি এ কারণেই তাঁর জন্য যথার্থ।