ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ি খাদ্য গুদামে চালবাজি

খাদ্য কর্মকর্তা নিজেই সিন্ডিকেটের হোতা!

by

সরকারের আভ্যন্তরীণ বোরো সংগ্রহের নামে নির্দিষ্ট মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতে খাদ্য গুদামে মজুদ রাখা হয় প্রতিবছর। চলতি বছর এই চাল দিতে তালিকাভুক্ত মিলারদের নির্দিষ্ট পরিমাণ ধার্য করে দেওয়া হয়েছে। আর মিলাররা তা করবেন মানসম্মত ধান কিনে তা থেকে চাল বের করে খাদ্যগুদামে জমা দিতে হবে। 

এই অবস্থায় নিয়ম ভঙ্গ করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে খোদ খাদ্য কর্মকর্তাই সিন্ডিকেটের হোতা সেজেছেন। তিনি বরাদ্দ সম্পন্ন করতে নিম্নমানের চাল বাহির থেকে এনে গুদামে মজুদ রাখার চেষ্টা করে ফেঁসে গেছেন। ইউএনও’র হস্তক্ষেপে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। এ ধরনের ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের আঠারবাড়ি খাদ্যগুদামে। আজ খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সত্যতা পেয়েছেন। সেই সঙ্গে ওই খাদ্য কর্মকর্তাসহ  জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজধারী মামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের আগের দিন বিকেলে জনৈক আবদুল মতিন ওরফে মতি নামে এক ব্যক্তি একটি পাওয়ার ট্রলিতে করে চালের বস্তাগুলো ওই খাদ্যগুদামে পৌঁছান। পরে খাদ্য কর্মকর্তা মো. আশরাফ আলীর নির্দেশে গুদামের শ্রমিকরা চালগুলো গুদামের ভেতরে নিয়ে স্তুপ করে রাখেন। শ্রমিক সর্দার মো. ছফির উদ্দিন খাদ্যগুদামের ভেতরে আবদুল মতিনের চাল প্রবেশের তথ্যটি মুঠোফোনে নিশ্চিত করে বলেন, উনার (খাদ্য কর্মকর্তা) সঙ্গে মতি মিয়ার পূর্ব পরিচয় থাকায় তার মাধ্যমেই ব্যাপক দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। আমরা কোনো প্রতিবাদ করলে লেবারি থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেন।

গতকাল মঙ্গলবার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন আঠারবাড়ি খাদ্যগুদামের এক নম্বর ভবন আকস্মিকভাবে পরিদর্শন করে সরকারি বস্তা ছাড়া চালের মজুদ দেখতে পেয়ে তা জব্দ করেন। জব্দকৃত চালের পরিমাণ ৩৯৫০ কেজি। ইউএনও এ বিষয়ে খাদ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিবেদন প্রেরণ করেন।

আজ বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে আঠারবাড়ি খাদ্যগুদামে গিয়ে দেখা যায়, এক নম্বর গুদামটি সিলগালা করা। গুদাম চত্বরে দাঁড়ানো ছিলেন ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) মো. আশরাফ উদ্দিন। তাঁকে  ঘিরে কথা বলছেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। পরে জানা যায় ওই ব্যক্তিরা হচ্ছেন তালিকাভুক্ত মিলার।

চালের অতিরিক্ত মজুদ সম্পর্কে জানতে চাইলে আশরাফ উদ্দিন দাবি করেন, স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট তাঁকে হুমকি ও ভয় দেখিয়ে ফরিদা রাইস মিলের নামে ৭৯ বস্তা (৩৯০ কেজি) চাল গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। হুমকি দেওয়ার বিষয়টি প্রশাসনকে জানাননি কেন প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। 

সিন্ডিকেট সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নান্দাইল উপজেলার আবদুল মতিন ওরফে মতি মিয়া ছাড়াও আঠারবাড়ি এলাকার কয়েকজন সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি খাদ্যগুদামে চালের অতিরিক্ত মজুদ ধরা পড়ার পর ওই ব্যক্তিরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। যে ‘ফরিদা রাইস মিলের’ নামে খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ করা হয়েছে সেটি আঠারবাড়ি রায়ের বাজার টিএন্ডটি রোডে অবস্থিত। সেখানে গেলে মিলের মালিক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, এ ধরনের কাজে যারা তাঁর মিলের নাম জড়িয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। তাঁর মিল ৫৭ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল সরবরাহের জন্য খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আঠারবাড়ি এলাকার অটোরাইস মিলের একজন মালিক বলেন, খাদ্য কর্মকর্তার যোগসাজশ ছাড়া সরকারি গুদামে চাল প্রবেশ করানো সম্ভব নয়। যদি তা-ই না হতো তাহলে ফড়িয়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের চাল কীভাবে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত খাদ্যগুদামে নির্ধিদ্বায় প্রবেশ করে। সূত্রটির কাছ থেকে এ বিষয়ে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। সূত্রটি থেকে জানা যায়, চাল সরবরাহের লক্ষমাত্রা পুরণের জন্য মিল মালিকরা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে থাকেন।

এসব ক্ষেত্রে অনেক মিল মালিক সিন্ডিকেটে থাকা ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজার দরের চেয়ে কম মূল্যে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের চাল কিনে বস্তাবদল করে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা মিলের নামে খাদ্যগুদামে সরবরাহ করে থাকে। 

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন বলেন, এ এক ভয়ানক ঘটনা। এর জন্য খাদ্য কর্মকর্তা আশরাফ আলী সরাসরি জড়িত। সেই সিন্ডিকেটের হোতা। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খাদ্যবিভাগের মহাপরিচালক মহোদয়ের বরাবরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করার জন্য খাদ্য বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনার পর দেশের সকল উপজেলায় খোঁজ নেওয়া দরকার।