মহামারীতে নিউটনের সাফল্য ও আমাদের অলসতা!
by ইশতিয়াক আকিব
২৫ জুলাই, ১৬৬৫। জন মোরলে নামে পাঁচ বছরের এক ছেলে নিজের বাসায় মারা যায়। সেটাই কেমব্রিজে প্লেগে প্রথম মৃত্যু। দ্রুত লোকজন আইসোলেশনের জন্য শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিল আর এই শহরছাড়াদের দলে ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের ২৩ বছরের এক ছাত্র- আইজ্যাক নিউটন। কেমব্রিজ থেকে ষাট মাইল উত্তরে উলসথর্প গ্রামে ছিল নিউটনের বাড়ি। প্লেগের থেকে বাঁচতে সেখানেই চলে যান নিউটন। প্রায় দুবছর সেখানেই কাটান। সেই অবসরে তিনি আবিষ্কার করেন মানব সভ্যতাকে বদলে দেওয়া প্রকৃতি আর গণিতের যুগান্তকারী সব তত্ত্ব- ক্যালকুলাস, গতিবিদ্যা, মহাকর্ষ, আলোকবিদ্যা ইত্যাদি। করোনাভাইরাসের ভয়াল সংক্রমণে পৃথিবী থমকে যাওয়ার এই সময়ে আপনিও তো নিউটনের মতই ঘরে বসে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া নিউটন সেই অবসরে পৃথিবী বদলে দিয়েছিলেন, আপনি করছেনটা কী?
ঘরে বসে ফোন টিপতে টিপতে নানা ধরনের লেখা বা অন্তত ফেসবুক পোস্ট নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। তাই ব্যর্থ একটা কোয়ারেন্টিন কাটানোই আপনার কি লজ্জ্বা পাওয়া উচিত নয়?
না। প্রথমত, আমরা কেউই এবং সম্ভবত মানবসভ্যতার ইতিহাসে কেউই নিউটনের কাছাকাছি সাফল্য অর্জন করতে পারবে না হয়তো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শুধু মহামারীর কারণেই নিউটন তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন, এ কথাটা জনপ্রিয় হলেও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। সম্ভবত এই ধারণার শুরুটা সেই নিউটনের আপেল গাছ থেকে। বিখ্যাত ফরাসী লেখক ও দার্শনিক ভলতেয়ারের সুবাদে সে গল্পটা পৌঁছে যায় পৃথিবীর সব কোণে, সব সময়ে।
নিউটন জীবনের শেষ দিকে এসে নিজেও গল্পটা বলেছিলেন। তাঁর বাড়ির দরজার সামনেই একটা আপেল গাছ (এখনো সেই গাছের বংশধর এবং সেই জায়গাতেই), তার নিচে বসে ভাবছিলেন নিউটন। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারেন আপেলের মাটিতে পড়া আর পৃথিবীর চারদিকের চাঁদের ঘুরে চলার কারণ আসলে একই। এই গল্প আমাদের ভুল শিক্ষা দেয়, অনেকেই ভাবে সাফল্য বুঝি এভাবে হুট করেই আসে। এর জন্য হাড়ভাঙা খাটুনির দরকার নেই- এক মুহূর্তে একটা আলোর ঝলকানির মত চলে আসবে যুগান্তকারী ধারণা। অবশ্য তার জন্য দরকার সঠিক পরিবেশ- যেমনটা নিউটন পেয়েছিল আর আমরা পেয়েছি মহামারীর কারণে আইসোলেশনে থাকার দরুন।
এ কথা সত্যি, মহামারির দুই বছরে নিউটন গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য সব আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো আইসোলেশনে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেই নিউটন এই সাফল্য পেতে সক্ষম হন, এই ধারণায়। নিউটন যখন কেমব্রিজে ছিলেন, তখনই আসলে মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। নিউটনের হাতে লেখা একটা নোট ছিল- বিজ্ঞানের অমিমাংসিত কিছু সমস্যার তালিকা, যেগুলো নিয়ে তিনি কাজ করতে চান। সেই তালিকায় ছিল কিছু দার্শনিক সমস্যা (বিজ্ঞানকে সে যুগে প্রাকৃতিক দর্শন বলা হতো)- যেমন, সময়, স্থান, গতি, মহাকর্ষ, আলো, রং ইত্যাদি। এর সবগুলো নিয়েই পরের দশকগুলোতে নিউটন কাজ করেছেন। মহামারীর আগে কেমব্রিজে থাকাকালীন ক্যালকুলাস এবং জ্যামিতির নতুন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছিলেন। তেমনি মহামারীর পরেও পরেও শেষ হয়নি তাঁর সব গবেষণা। কেমব্রিজে ফিরেও তাই গবেষণা চালিয়ে যান নিউটন। আলো নিয়ে তাঁর গবেষণা শেষ হয় ওই দশকের প্রায় শেষ দিকে এসে। গণিত ও জ্যামিতির অনেক কাজ এরপরেও চলতে থাকে। মহাকর্ষ নিয়ে তার ভাবনাগুলো একীভূত করে সত্যিকারের পাঠযোগ্য রূপে নিয়ে আসতে সময় লাগে প্রায় দুই দশক। তাই নিউটনের দুই দশকব্যাপী নিরলস পরিশ্রমের চেয়ে দুই বছরের আইসোলেশন অথবা গাছ থেকে আপেল পড়ার মুহূর্তটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল- এমনটা দাবি করা ঠিক বিজ্ঞানসম্মত নয়। নিউটনকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি মহাকর্ষ সূত্র কীভাবে আবিষ্কার করেন? তার উত্তর ছিল, ‘নিয়মিত এটা নিয়ে চিন্তা করে।’
কাজটা করে যাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ- যেমনটা নিউটন করেছিলেন কেব্রিজে ছাত্রজীবনে, আইসোলেশনের দুবছরে এবং কেমব্রিজে ফেরত আসার পরেও, এমনকী কেমব্রিজের অধ্যাপক হওয়ার পরেও। নিউটনের সেরা সময়টা এই দেড় বছরের নয়, অন্তত অর্ধদশক। ঘরে আটকা পড়েছিলেন বা আপেলটা টুপ করে পড়েছিল বলে নয়, বরং অনেকদিন নিরলসভাবে ভাবছিলেন, হিসেব-নিকাশ করছিলেন বলেই নিউটনের কাছে ধরা দিয়েছিল সাফল্য। তাই করোনার সময়ে আইসোলেশনে থেকে আপনাকে নিউটন হতে হবে না- করোনার আগে যা নিয়ে আপনার চিন্তার জগৎ ঘিরে রেখেছিল, তা নিয়েই এখন কাজ করতে থাকুন, মহামারী শেষেও সেটা নিয়েই লেগে থাকুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি