করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন সি ও ডি-র প্রভাব
by ড. রউফুল আলমরসায়নে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিং ছিলেন ভিটামিন সির সবচেয়ে জনিপ্রয় প্রচারক। তিনি সবাইকে নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণের কথা বলতেন। পাউলিং বিভিন্ন রোগের জন্য শরীরে উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি প্রয়োগের কথাও বলেছিলেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের গল্পের প্রচলন আছে। করোনা মহামারীর এই সময়ে পাউলিং বেঁচে থাকলে কী উপদেশ দিতেন, সেটা আমরা বলতে পারছি না। তবে জীবদ্দশায় দেওয়া তাঁর উপদেশ এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন সি ও ডি’র প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব আছে কিনা সেটার পরীক্ষামূলক প্রমাণ (Experimental Evidence) এখনো আমাদের হাতে নেই। তবে গবেষকরা বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে, ভিটামিন সি ও ডি’র পরোক্ষ প্রভাবের বিষয়ে এখন আশাবাদী।
ভিটামিন সি মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। স্বাভাবিকভাবেই, কারও শরীরে যদি এর ঘাটতি থাকে, তাহলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ভিটামনি সি’র রাসায়নিক নাম হলো এসকরবিক এসিড। এটি পানিতে দ্রবীভূত হয়। আরেকটা বিষয় হলো, মানবদেহ অন্যান্য অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো ভিটামিন-সি নিজ থেকে তৈরি করতে পারে না। তাছাড়া এটা পানিতে দ্রবীভূত হওয়ায় শরীর থেকে এটা নিষ্কাসিত হয় সহজেই। তাই মানবদেহে প্রতিনিয়তই ভিটামিন-সি প্রয়োজন হয়।
বিভিন্ন ফল-মূল ও সবজিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন সি থাকে। যেমন লেবু, কমলা, মাল্টা, বাতাবিলেবু বা জাম্বুরা, কাঁচা মরিচ, টমেটো, পেঁপে, পেয়ারা, আমলকি, ব্রুকলি, গাজর ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। খাদ্য দ্রব্য ছাড়াও ভিটামিন সি ফার্মেসি থেকে কিনে সেবন করা যায়।
ভিটামিন সি’র মতো ভিটামিন ডি কিন্তু পানিতে দ্রবীভূত হয় না। তবে ফ্যাট বা চর্বিতে দ্রবীভূত হয়। ভিটামিন ডি মানবদেহে তৈরি হয়। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো (Photon)। এজন্য আমরা প্রায়-ই শুনতে পাই, সূর্যের আলো ভিটামিন ডি তৈরিতে সহায়ক। শীতপ্রধান দেশের মানুষ খুব বেশি সূর্যের আলো পায় না। ফলে সে সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি খুব বেশি।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণে জানা গিয়েছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষদের বেশিরভাগেরই ভিটামিন ডি’র ঘাটতি ছিল। এ বিষয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য মতবাদটি হলো, রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি থাকলে সেটা সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine Storm) নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণ করোনাক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতি মিলিলিটার রক্তে কমপক্ষে ২০ ন্যানোগ্রাম বা তার বেশি ভিটামিন-ডি থাকা উচিত। যদি রক্তে ভিটামিন ডি’র পরিমাণ মিলিলিটার প্রতি ১২ ন্যানোগ্রাম গ্রাম বা এরচেয়ে কম হয়, তাহলে সেটাকে ভিটামিন ডি ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাধারণত গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের শরীরে ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকার কথা নয়। তবুও খাবারের ধরন ও বৈচিত্রের অভাব বা অন্যকোনো সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকের শরীরে ভিটামিন ডি’র ঘাটতি থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে দুধ, পনির, দই, সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল, ডিমের কুসুম, প্রাণীর কলিজা ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সরাসরি ভিটামিন ডির সাপ্লিমেন্টও সেবন করা যেতে পারে।
করোনার যেহেতু এখন পর্যন্ত তেমন কোন প্রতিষেধক বা কার্যকরি ওষুধ নেই, তাই শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে শরীরে ভিটামিন সি ও ডির লেভেল ঠিক রাখার জন্য এ সব ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। তাছাড়া এই ভিটামিন দুটোতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। তাই অনেক বিশেষজ্ঞই পরিমাণমতো ভিটামিন সি ও ডি’র সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেন।
লেখক: গবেষক, পিটিসি থেরাপিটিকস ইনকর্পোরেট, সাউথ প্লেইনফিল্ড, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র