কৃষি শ্রমিকের সঙ্গে যন্ত্রকে সমন্বয় করা চ্যালেঞ্জ
by আমানুর রহমান রনিবাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শিল্পায়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ, খাদ্য উদ্বৃত্তের সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের গ্রাফ বিপরীতমুখী। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ছাড়া কৃষি শ্রমিকের সংকট দৃশ্যমান হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্র যত শিল্পায়ন হবে কৃষি শ্রমিকের সংকট তত প্রকট হবে। এজন্য শ্রমিকের সঙ্গে সমন্বয় করে ধীরে ধীরে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। তারা বলছেন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতেই যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। তবে কৃষি শ্রমিকের স্বার্থেই কৃষিকে শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ করা যাবে না। তাহলে অনেক কৃষক বেকার হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ১৫ বছর বয়সের বেশি জনসংখ্যার ৪০ দশমিক ১ শতাংশ কৃষির সঙ্গে জড়িত। আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনও শ্রমিক সংকট নেই। তবে সিজনাল ফসল রোপণ ও কাটার সময় যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তখন অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত ফসল তোলার জন্য বেশি শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এজন্য সংকট দেখা যায়।’
তিনি বলেন, ‘ধীরে ধীরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। তবে শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ করা যাবে না। কারণ, আমাদের ম্যানুয়াল কৃষক অনেক। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে।’
২০১৮ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিরি)-সহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কৃষি যান্ত্রীকিকরণ ও ম্যানুয়াল অবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা করে। সেই গবেষণায় জমি তৈরি থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষির যান্ত্রীকিকরণ দেখানো হয়েছিল। বর্তমানে সেই চিত্র আরও উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ওয়াইস কবির। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন চিত্র বাংলা ট্রিবিউনের কাছে তুলে ধরেছেন তিনি।
যান্ত্রিক উপায়ে প্রস্তুত হয় ৯৮ শতাংশ জমি
বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ১৯৬০ সালে শুরু হলেও ১৯৯০ সালের পর আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ফসল ফলানোর জন্য ৯৮ শতাংশ জমি যন্ত্র বা মেশিনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। এরমধ্যে ট্রাক্টর ১৮ শতাংশ, পাওয়ার টিলার ৮০ শতাংশ। বাকি দুই শতাংশ জমি কৃষক গবাদিপশুসহ বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করেন। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. ওয়াইস কবির বলেন, ‘প্রতিবছর ১০ হাজার পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর যোগ হয়। কিছু নষ্ট হয়। কৃষকের কাছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কারণ, তারা এটাকে বিভিন্ন কাজে লাগাতে পারছেন।’
যান্ত্রিক উপায়ে বীজ-চারা রোপণ দশমিক ১০ শতাংশেরও কম
দেশে চারা বা বীজ রোপণ প্রায় শতভাগ ম্যানুয়ালি করা হয়ে থাকে। ধানের চারা প্রায় শতভাগ হাতেই রোপণ করা হয়। দশমিক ১০ শতাংশের কম জমিতে মেশিন বা যন্ত্র ব্যবহার করে চারা রোপণ করা হয় বলে জানিয়েছেন ড.ওয়াইস কবির।
জমিতে সার প্রয়োগ শতভাগ হাতে
জমিতে সার প্রয়োগ এখনও যান্ত্রিকীকরণ হয়নি। কৃষকরা এটি হাতেই করে থাকেন। শতভাগ সার হাতেই দেওয়া হয়।
নিড়ানি ৮০ শতাংশ যান্ত্রিক
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিরি)গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ জমিতে মেশিনে নিড়ানি করেন কৃষকরা। বাকি ২০ শতাংশ হাতে করেন। এক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা বেশি কাজ করেন।
স্প্রে ৯৯ শতাংশ যান্ত্রিক
ধানসহ সব ফসলের জন্য এখন যান্ত্রিক উপায়ে কীটনাশক স্প্রে করা হয়। কোনও কোনও প্রান্তিক কৃষক বড় বড় প্লাস্টিকের ঘামলায় কীটনাশক মিশ্রণ করে ছিটিয়ে থাকেন। তবে তা এক শতাংশেরও কম।
সেচ শতভাগ যান্ত্রিক
বাংলাদেশে সেচের কাজ শতভাগ যান্ত্রিক হয়ে গেছে। এখন মানুষ আর হাতে সেচ করে না। সেচের ক্ষেত্রে দুই ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়— বৈদ্যুতিক ও ডিজেল। তবে ডিজেলেই বেশি করা হয়।
ধান কাটা ৮/১০ শতাংশ যান্ত্রিক
ধান কাটার কাজে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে কয়েকবছর আগে। এ কাজে মূলত দুই ধরনের মেশিন ব্যবহার করেন দেশের কৃষকরা। একটি রিপার, অপরটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার। রিপার দিয়ে কেবল ধান কাটা যায়। আর কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধানকাটা, মাড়াই থেকে শুরু করে বস্তায় ভরা পর্যন্ত করা যায়। এই মেশিনের দাম অনেক বেশি। প্রতিটি মেশিন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এই মেশিন কেনার জন্য হাওর অঞ্চলে ৭০ শতাংশ ও এবং অন্যান্য অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এরপরও কৃষককে ৬ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত যোগান দিতে হয়। এজন্য সরকার কৃষকদের ছোট ছোট গ্রুপ করে দিয়েছে, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে মেশিন কিনতে পারেন। এ তথ্য জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ৮৯৬টি কম্বাইন্ড হারভেস্ট এবং প্রায় ৫ হাজার রিপার মেশিন রয়েছে। এ দিয়ে ১০ শতাংশ জমির ধান কাটা যায়।’
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. ওয়াইস কবির বলেন, ‘সারাদেশের ধান কাটতে এ ধরনের ৩০ হাজারের বেশি কম্বাইন্ড হারভেস্ট মেশিন প্রয়োজন।’
ধান মাড়াই ৮০ শতাংশ যান্ত্রিক
ধানের মাড়াই এখন ৮০ শতাংশই যান্ত্রিক উপায়ে হচ্ছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে এসব ছোট ছোট মাড়াই মেশিন তৈরি হয়েছে। মেশিনগুলো নারীরাও অপারেট করতে পারেন বলে জানিয়েছেন কৃষি গবেষকরা।
ধান মেশিনে শুকানো হয়
দেশে এখনও প্রায় শতভাগ ধান রোদে শুকানো হয়। এজন্য প্রকৃতির ওপরে নির্ভর করতে হয়। ধান শুকাতে অন্তত চার দিবসের রোদের দরকার হয় জানিয়ে ড. ওয়াইস কবির বলেন, ‘বড় রাইস মিলগুলোতে ড্রায়ার মেশিন আছে। তারা মেশিনে শুকায়। সরকার যে ধান কৃষকের কাছে থেকে কিনে নেয়, সেটা ময়েশ্চারাইজার মেশিনে ঠিক করা হয়। তবে কৃষক পর্যায়ে কোন ড্রায়ার মেশিন নাই।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসির উদ্দিন বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে আমরা ড্রায়ারকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি না। ইউনিয়ন পর্যায়ে আমরা ময়েশ্চারাইজার মাপার একটি করে মেশিন দিয়েছি। প্রায় দুই হাজার মেশিন দেওয়া হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা ময়েশ্চারাইজার মেশিন দিয়ে ধানের ময়েশ্চার মেপে কৃষকদের বলে দেন কতটুকু রোদে শুকিয়ে গুদামে নিয়ে আসতে হবে।’
মিলিং শতভাগ যান্ত্রিক
দেশে এখন ধান শতভাগ মিলিং হচ্ছে। আধুনিক অটো মেশিনে ধান মিলিং করা হয় বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. ইসমত আরা বেগম।
যান্ত্রিকীকরণে লাভ কত
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে এক হেক্টর (২.৪৭ একর) জমির ধান কাটতে লাগে ১৮ জন শ্রমিক। এ পরিমাণ ধান প্রথাগত পদ্ধতিতে কাটতে ৬১ জন শ্রমিক লাগে। দিনে হারভেস্টারে প্রায় সাড়ে ৩ হেক্টর জমির ধান কাটতে সর্বোচ্চ ৬৩ জন শ্রমিক লাগবে। সেখানে প্রথাগতভাবে লাগবে ন্যূনতম ২১৩ জন শ্রমিক। সাধারণভাবে একটি কম্বাইন হারভেস্টারে একজন কৃষক এক ঘণ্টায় এক একর জমির ধান একইসঙ্গে কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দি অনায়াসেই করতে পারেন। এক দিনে হারভেস্টার দিয়ে ১০ একর পর্যন্ত জমির ধান কাটতে খরচ হয় মাত্র ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রথাগতভাবে সেটি করতে খরচ হবে ৭৫ থেকে ৯০ হাজার টাকা। ফলে কম্বাইন হারভেস্টারে ১০ একর জমির ধান কাটার মাধ্যমে দিনে সাশ্রয় হবে দেড়শ’র বেশি শ্রমিক বা প্রায় ৫৫ হাজার টাকা।
কশি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, যান্ত্রিকীকরণ হলে কৃষক প্রতি একরে তিন হাজার টাকার লাভবান হবেন।’
বাংলাদেশে কৃষি শ্রমিকের চিত্র
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. ইসমত আরা বেগম বলেন, ‘১৫ বছরের বয়সের ওপরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০.৬ শতাংশ লোক কৃষিতে কর্মরত। এরমধ্যে ৫৯.৭০ শতাংশ নারী কৃষক এবং ৪০.৩০ শতাংশ পুরুষ। দেশ শিল্পায়ন হওয়ার কারণে পুরুষরা এখন অন্য পেশায় যাচ্ছে। নারীরা কৃষির সঙ্গে বেশি জড়িত।’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের কৃষি শ্রমিকের কোনও সংকট নেই। তবে বোরো ও আমন ধানের মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে কৃষককে দ্রুত ধান তুলতে হয়। তখন শ্রমিকের সংকট দেখা যায়।’
কৃষকের বক্তব্য
কৃষি কাজে যন্ত্রের ব্যবহারে খুশি কৃষকেরাও। এতে তাদের খরচ কোনও কোনও ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও কম বলে দাবি করেছেন তারা। ময়মনসিংহের চর ঈশ্বরদীর কৃষক আলমগীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দ্রুত সবকিছু করা যায় মেশিনে। সময় বাঁচে, টাকা বাঁচে এবং পরিশ্রম কম হয়। তাই কৃষিতে মেশিন বা যন্ত্র ব্যবহার করা লাভ।’
যান্ত্রিকীকরণে যেতে হবে ধীরে ধীরে
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যে দেশে ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত, সে দেশে রাতারাতি যান্ত্রিকীকরণ করা সম্ভব না। এসব মানুষের একটি ব্যবস্থা করে ধীরে ধীরে যান্ত্রিকীকরণে যেতে হবে। দ্রুত যান্ত্রিকীকরণে গেলে মানুষ বেকার হয়ে যাবে। অন্য সেক্টরে চাপ বাড়বে। শ্রমের দাম কমে যাবে।’
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের জন্য সরকার ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরের একটি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এখনও আমাদের কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ বলা যাবে না। কারণ, আমাদের ধান কাটা ও রোপণ এখনো সনাতনও পদ্ধতিতেই হয়। রোপণতো পুরোপুরি হাতেই হয়। তাই যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে এই কথা আমরা এখনই বলতে পারি না। তবে আমরা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ করতে চাই। সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ চলছে।’
তবে কৃষিকে বানিজ্যিকিকরণের পক্ষে নন তিনি। সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষি আমাদের পারিবারিক পেশা। এটা বানিজ্যিকিকরণ করা যাবে না। এটা বানিজ্যিকিকরণ এখনই ঠিক হবে না। কারণ, পরিবারের সবাই এর সঙ্গে জড়িত। কোনও কোনও ফসলকে বাণিজ্যিকিকরণ করা যায়, তবে পুরো কৃষিকে করা যাবে না।’