তাঁদের ঈদ কেটেছে পাহাড়ে, বনে, দ্বীপে
by সজীব মিয়া, ঢাকাতাঁরা কেউ বেড়াতে গিয়ে থেকে গেছেন দূর দ্বীপে বা উপত্যকায়, কেউবা পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন জনবিচ্ছিন্ন এলাকায়। অবরুদ্ধ সময়ে সবার ঈদই কেটেছে ভিন্ন আবহে, তবে এই মানুষদের ঈদ উদযাপনে ছিল বাড়তি ভিন্নতা। সে গল্পই শোনালেন তিনজন।
বনরক্ষীর ঈদ
পেশাগত দায়িত্বে তিন মাস ধরে গভীর সুন্দরবনে আছেন বনরক্ষী রাসেল মিয়া। তাঁর অবস্থান এখন নীলকমল বন ফাঁড়িতে (বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এটি হিরণ পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত)। লোকালয় থেকে নৌযানে সেখানে পৌঁছাতে ছয়-আট ঘণ্টা লাগে।
১২ জন সহকর্মী নিয়ে সেখানেই ঈদ উদযাপন করলেন রাসেল মিয়া। এবার তাঁর জীবনে ঈদ এসেছে ভিন্ন বাস্তবতায়। গত বছরের মাঝামঝি বিয়ে করেছেন। বিবাহিত জীবনে এটিই তাঁর প্রথম ঈদ। অনেক স্বপ্ন ছিল ঈদের দিনটি পরিবারের সঙ্গে কাটানোর। নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়ার। রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার এই পরিস্থিতিতে হয়তো কারও বাড়িতে যেতে পারতাম না, তবু তো পরিবারের মানুষের সঙ্গে থাকতে পারতাম।’
রাসেল মিয়া দিন কয়েক আগেই মুখোমুখি হয়েছেন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের। বিরূপ পরিস্থিতে কেটেছে দুদিন। পরিবারের সদস্যেরা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। রাসেল বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের এ দিকটায় তেমন ক্ষতি হয়নি। আমাদের থাকার ঘরটা পাকা বলে অনেকটাই নিরাপদে ছিলাম। তবে নির্জন বনে ভয় তো করেছেই।’
এক বছর পর পর তাঁদের বদলির নিয়ম। রাসেল জানেন না ঠিক কবে ফিরতে পারবেন। সুন্দরবনের গভীরে হলেও রাষ্ট্রয়াত্ত মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে সেখানে। তাই প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। রাসেল জানালেন, স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরাও চান না, এমন পরিস্থিতে ছুটিতে আসেন তিনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমলে তবেই বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা রাসেলেরও।
আদনান আছেন সাদা মেঘের সাজেকে
আদনান জুবাইদের দিনমান অপেক্ষা এখন সাদা মেঘের আশায়। প্রায় সময়ই ক্যামেরা তাক করে ঘোরেন পাহাড়ের ভাঁজে জমে থাকা সাদা মেঘের ছবি তুলতে। বৃষ্টি থেমে গেলে পেয়ে যান প্রকৃতির অপরূপ সাজের ছবি। সাজেকের দিনগুলো এভাবেই কাটছে এই তরুণ পর্যটকের।
২৬ মে সাজেক উপত্যকায় কাটছে তাঁর ৬৯তম দিন। ব্যক্তিগত কাজেই খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙামাটির সাজেক উপত্যকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হতে থাকলে, তিনিও থেকে গেছেন সেখানেই। তারপর কেটে গেছে দুই মাসের অধিক সময়। এমন পরিস্থিতিতেই চলে এল ঈদুল ফিতর।
আদনান জুবাইদ বলেন, ‘এবারই আমার পরিবার ছাড়া প্রথম ঈদ। বাড়িতে থাকলে হয়তো ঘুরে বেড়াতে পারতাম না। তবু তো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাসার ছাদে নামাজ আদায় করা হতো। সময়টাও কাটত গল্প করে।’
আদনানদের বাড়ি গাজীপুরে। মা-বাবা গত হয়েছেন, বাড়িতে আছেন বড় ভাইয়ের পরিবার। সবার সঙ্গে কথা বলে ঈদের সকালে শুরু হয়েছে তাঁর। স্থানীয় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ক্যাম্পে নামাজ আদায় করেছেন। যে রিসোর্টে থাকছেন, সেখানেই রান্নার বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। সেমাই আর মুরগির মাংস রেঁধেছেন ঈদের দিন। খোলা বারান্দায় বসে নিজের রান্না করা খাবার খেতে খেতে মেঘ পাহাড়ের বন্ধুত্ব দেখে কাটিয়েছেন দিন।
আদনান জুবাইদ বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী কমিটি করেছে। ভীষণ কড়াকড়িভাবে নিয়ম মানছে তারা। সাজেকের বাইরে থেকে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এখান থেকে কেউ গেলে যেতে হচ্ছে একেবারে।’
প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকলেও পানি আর বাঙালি খাবার খেতে না পাওয়ার কিছুটা কষ্ট পোহাতে হয় আদনানকে। তবে এমন কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন তিনি। তাই তো বলছিলেন, ‘পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক হয়েছে। অনেক সময় তাঁদের সঙ্গে দুর্গম পাহাড়ে চলে যাই, ছবি তুলি, তাদের খাবারই খাই। সব মিলে জীবনটা সুন্দর।’
এনজামুলের ঈদ সেন্ট মার্টিনে
‘কোন ঈদে কি করেছি মনে না থাকলেও, ২০২০ সালের ঈদুল ফিতর কীভাবে কাটালাম, তা ঠিকই জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ঈদ উদযাপনের অনুভূতি এভাবেই জানালেন এনজামুল হক।
ঢাকার এই তরুণ এখন আছেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। সেখানে আজ তাঁর কাটছে ৭৩তম দিন। গত মার্চে সাতজনের একটি দলের হয়ে অবকাশযাপনে গিয়েছিল সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। নির্দিষ্ট সময়ে চারজন ফিরে এলেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা আর ছুটির পূর্বাভাস পেয়ে স্বেচ্ছায় থেকে যান তিনিসহ দলের আরশাদ হোসেন ও সালেহ রেজা। এনজামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারের ঈদ সবার জন্যই অন্য রকম, তবে আমাদের জন্য একটু বিশেষভাবে অন্য রকম।’
দ্বীপে দাঁড়িয়ে ঈদের চাঁদ দেখার মুহূর্ত মনে করে তিনি জানলেন, শেষ রোজার ইফতারের পর দলেবলে দাঁড়িয়েছিলেন সৈকতে। একসময় জ্বলজ্বল করে আকাশে দেখা দেয় শাওয়াল মাসের চাঁদ। সে ছবি নিজের ফেসবুকে প্রোফাইলে পোস্ট করে বন্ধুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি।
এনজামুল বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর আকাশ বেশ পরিষ্কার। তাই চাঁদ খুঁজতে হয়নি। তবে চাঁদটা দেখার পর অন্য রকম একটা শূন্যতা ভর করেছিল মনের ভেতর। কেননা এবারেই প্রথম বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও ঈদ করছি।’
তাঁরা থাকছেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের একটি রিসোর্টে। মার্চে নির্দিষ্ট সময় পর বিনে পয়সায় সে রিসোর্টেরই একটি কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাঁদের। পর্যটক না থাকায় রিসোর্টের দুজন কর্মীর সঙ্গে এক চুলায় খাবার রান্না করে খাচ্ছেন। বন্ধুত্ব হয়েছে স্থানীয়দের সঙ্গেও।
এনজামুল বলছিলেন, ‘সেন্ট মার্টিনে আমাদের কিছু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। পেয়েছি আমাদের মতোই দ্বীপে থেকে যাওয়া আরেকজন পর্যটককে। এমন চারজনকে দাওয়াত করেছিলাম। ঈদের নামাজ পরে এসে রান্না করে তাদের আপ্যায়ন করেছি। এমন দিন কাটাতে পেরে সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো।’
রিসোর্টে তাঁদের রুমটা সৈকতের পাশে। দ্বীপে কাটানো দিনের কথা শুনি তাঁর কাছে। এনজামুল জানালেন, তাঁরা ঘুমাতে যান সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ শুনে আবার ঘুম থেকে জেগে উঠেন ঢেউয়ের শব্দে। প্রতিদিন বিকেল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সৈকতে বসে কাটিয়ে দেন। ছবি তুলেন, ভিডিও করেন। সেসব পোস্ট করেন ফেসবুকে।
তবে ঈদের দিন বাড়তি রোমাঞ্চ নিয়ে ঘুরে এসেছেন ছেঁড়াদ্বীপ। এনজামুল যেমনটি বলেন, ‘ঈদের দিন স্থানীয় তরুণেরা ঘুরতে যায় ছেঁড়াদ্বীপে। শান্ত সমুদ্রের তিনটি দিক দেখতে আমরাও সেখানে গেলাম। কিছু সময় কাটিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ফিরে এলাম রিসোর্টে।’