শৈশবের সেই ঈদের আনন্দ ফুরিয়ে গেছে কবেই
by মনিরুল ইসলামছোটবেলায় সারাটা বছর জুড়ে রমজানের অপেক্ষা করতাম। রমজান আসলেই ঈদ হবে, আর ঈদের একটা পরিকল্পনাতেও তো ছিল প্রবল উত্তেজনা। কয়েক মাস ধরেই আব্বা-মার আলোচ্য বিষয় থাকতো নতুন জামা কেনার সম্ভাব্য ব্যয়। স্বচ্ছল পরিবার না হলেও মোটামুটি চলে যেত কিন্তু বন্যা কিংবা খরার কারনে কোন কোন বছর ফসলহানি হলে আমাদের জামা কেনাটা খুব কঠিন হয়ে উঠতো। পুরোটা না বুঝলেও আলোচনা এবং উদ্বেগটা ধরে ফেলতাম। বছরে ঐ একবারই আমাদের জামা কেনা হতো। কেনা বললে ভুল হবে, মূলতঃ জামার কাপড় কিনে দর্জির কাছে পৌঁছানো হতো।
সাধারণতঃ ভাঙ্গা (বাজার) থেকে বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে অপেক্ষাকৃত কম দামের কাপড়ই কেনা হতো। কবে জামার ডেলিভারি পাওয়া যাবে-কাউন্ট ডাউন চলতো। দু’তিন দিন আগে থেকে মহা উত্তেজনা বিরাজ করতো। নির্ধারিত তারিখে দর্জির দোকান থেকে জামা পড়ে ট্রায়াল দিতাম, যথাযথ হলে তো ভালো, নাহলে ভীষন মন খারাপ হয়ে যেতো। কাউন্ট ডাউন চলতে চলতে ঈদ চলে আসতো, আর ঈদ মানেই পোলাও, কোরমা আর মাংস সাথে বেগুন ভাজা। সকালেই শিন্নি (পায়েস) এবং সেমাই খেয়ে ঈদগাহ যেতাম। সন্ধ্যায় মন খারাপ হতো, এই ঈদ শেষ হয়ে গেল, আবার অপেক্ষা দুমাসের অর্থাৎ কোরবানির ঈদ। ঐ ঈদে জামার বিষয় নাই, মাংস তো খাওয়া যাবে। আসলে গ্রামে তখন অতি গুরুত্বপূর্ণ মেহমান কিংবা অনুষ্ঠান ছাড়া সেভাবে মাংস খাওয়ার চল ছিল না, সহজলভ্যও ছিল না। ঈদের সারা দিনেই আড্ডা দেওয়া, বিশেষ করে একটু ভালো খাওয়াই ছিল আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
চাকরিতে যোগদানের পরেও প্রথম ১০/১১ বছর অধিকাংশ ঈদই বাড়িতে করেছি। ঈদের আকর্ষণ তখনও ছিল। বাড়িতে গেলে সবার সাথে দেখা হতো। এসপি হিসেবে জেলায় দুটো ঈদ করেছি, তখন থেকেই মূলতঃ অফিসিয়াল ঈদ, পুলিশ লাইন্স, ডিসির বাসা, জেলা জজের বাসায় গমন এবং নিজের বাসায় অতিথি আপ্যায়ন নিয়েই দিন কেটে যেতো। ঢাকায় আসার পরে ঈদের ধরণ অনেকটাই পাল্টে যায়, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনেকগুলো অফিসিয়াল প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়। ছেলেমেয়ের সাথেই দেখা হয় রাতে। আমি বাইরে প্রোগ্রামে যাই আর বাচ্চারা কলিগদের বাচ্চাদের সাথে হৈ চৈ করে দিন কাটায়। শুধুমাত্র ঈদের দিনই নয়, গত কয়েক বছর ঈদের পরের দিনও দুপুর এবং রাতে অফিসিয়াল ফর্মালিটি থাকে। বেশি খাওয়া কিংবা ভালো খাওয়ার পাট তো কবেই চুকে গেছে, শারীরিক সমস্যা না থাকলেও রিচ ফুডে প্রবল অনীহা এখন।
পোশাক-পরিচ্ছদ এখন আর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করে না। বরং পোশাকের বিষয়ে আমার এক ধরণের উদাসীনতার কথাই কেউ কেউ বলেন। কাজেই, ঈদের দিন আর আলাদা কিছু মনে হয় না, বরং অন্যদিনের চাইতে অনেক বেশি ব্যস্ত একটা দিন। ছোটবেলার ঈদের সেই আনন্দ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। টিভি খুললেই মৃত্যু আর আক্রান্তের সংবাদ, ফেসবুক কিংবা মোবাইলেও পরিচিত জনদের সংক্রমণ কিংবা মৃত্যুর তথ্যে বিষন্ন হই। মানুষের বিরহ-বেদনা, রোগ-ব্যাধি, মৃত্যু-শোক ছিল, আছে এবং থাকবে, কিন্তু বর্তমান সংকটতো কবেই অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। একদিকে কয়েকজন সহকর্মীদের মৃত্যু অন্যদিকে অনেক সহকর্মী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। মনটা এমনিতেই খারাপ থাকে, তারপর, গতকাল ইন্সপেক্টর রাজুর জানাযা পড়ার পর থেকেই খারাপ লাগাটা বেড়ে যায়। তবুও তো আজ সূর্য উঠেছে, ঈদ এসেছে, বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তবে, এবারের ঈদের একমাত্র শান্তির জায়গাটা হলো মা সুস্থ আছেন এবং পরিবারের সবাই একসাথে সময় কাটাচ্ছি।
যে যেখানে আছেন, সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন।
শত্রু-মিত্র, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী-অশুভাকাঙ্ক্ষী, পরিচিত-অপরিচিত-সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মুবারক!
লেখক: অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।