ভাঙা বাঁধে ম্লান ঈদ আনন্দ

by

বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কায় থাকা খুলনার উপকূলীয় উপজেলা ও সুপার সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের ওপর পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছেন কয়রার প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ। আজ সোমবার সকালে ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তারা আবার বাঁধ মেরামত শুরু করেন। দুপুরে জোয়ারের আগ পর্যন্ত আংশিক বাঁধ মেরামত শেষে ক্ষুধার্ত মানুষেরা খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি ফেরেন। একই ভাবে মঙ্গলবার আবারো বাঁধ মেরামতে নামবেন তারা।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুপার সাইক্লোন আম্ফানের তাণ্ডবে কয়রা উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে চারটি ইউনিয়ন লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সোমবার ঈদের দিন সকালে প্রায় ৫ হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের ভাঙন মেরামত শুরু করে। বাঁধ মেরামতের এক পর্যায়ে কয়রা সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর কয়রা গ্রামের পশ্চিম পাশে শচিন মণ্ডলের বাড়ির পাশে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের পানির ওপর ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেন উপজেলা চেয়ারমান এস এম শফিকুল ইসলামসহ প্রায় ২ হাজার মানুষ। নামাজে ইমামতি করেন সাবেক উপজেলা চেয়ারমান আ খ ম তমিজ উদ্দিন।

অপরদিকে, বেড়িবাঁধের পূর্ব পাশে পানির মধ্যে ঈদের নামাজ করেন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। এখানে ইমামতি করেন কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির।

স্থানীয়রা জানান, ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে কয়রার পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি পয়েন্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে নোনা পানিতে তলিয়ে যায়। গত ২০ মে আম্ফানের আঘাতে কয়রার বেড়িবাঁধের ২৪ পয়েন্ট ভেঙে আবারও লোনা পানিতে সয়লাব হয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানালেও তা বাস্তবায়ন হয় না। সরকার মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা সাব কন্ট্রাকের মাধ্যমে কাজ করেন। ফলে বাঁধের জন্য বরাদ্দ সিংহভাগ অর্থই নষ্ট হয়। আর হাজার হাজার মানুষকে ফি বছর বিপদে পড়তে হয়। এ অবস্থা থেকে তারা অবসান চান।

পাউবো সূত্র অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় আইলার পর 'উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেজ-১' এর আওতায় খুলনাসহ উপকূলীয় ৬২৫ কিলোমিটার বাঁধ পুনঃনির্মাণে বৃহৎ প্রকল্প ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনার দাকোপে ৩১ নম্বর পোল্ডার এবং বটিয়াঘাটায় ৩০ ও ৩৪/২ পোল্ডারে বাঁধ পুনঃসংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও এ অঞ্চলের বেড়িবাঁধ নিয়ে মানুষের আতঙ্ক কমেনি। ২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফনী ও ১১ নভেম্বর বুলবুলের সময় উপকূলীয় কয়রা ও দাকোপে বড় আতঙ্ক ছিল বেড়িবাঁধ। আর গত ২০ মে আম্ফানের সময় এ আতঙ্ক প্রবল হয়ে ওঠে। আম্ফানের আঘাতে কয়রার বাঁধ ধ্বসে যায়। কয়রা উপজেলার চারটি ইউনিয়ন এখন নোনা পানির বদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, কয়রার মানুষ বাঁধ মেরামত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। কারণ বাঁধ আটকাতে না পারলে লোনা পানির মধ্যে বসবাস করা কঠিন হবে। কয়রার মানুষ এখন ত্রাণ চায় না, বাঁধ চায়। তাই সবাই মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করলেও তাদের পেটে দানা পানি প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন সেটুকুর জোগান দিয়ে লোনাপানিতে বিধ্বস্ত মানুষদের উৎসাহ দিচ্ছেন।

দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দা আবু সাঈদ খান বলেন, আইলায় বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মানুষ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আম্ফানে ঘর বাড়ি, বাঁধ সবই গেছে। তাই মানুষের ন্যূনতম আশ্রয় নেওয়ার অবস্থাও নেই। বাধ্য হয়ে এখন মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে আগে বাঁধ নির্মাণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাদা জলে নেমে পড়েছেন।

কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, আইলার পর থেকে এ জনপদের মানুষ বেড়িবাঁধ নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে। আম্ফানের আঘাতে সেই যুদ্ধ আবার নতুনভাবে শুরু করতে হল।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা সাংবাদিকদের বলেন, আইলা বিধ্বস্ত কয়রা এখন আম্ফানে বিধ্বস্ত হয়ে আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কয়রার ৪টি ইউনিয়রে সমগ্র এলাকা লোনা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। কয়রার মানুষ এখন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা ঈদের দিন বাঁধের ওপরই নামাজ আদায় করে সেমাই খেয়ে মেরামতে নেমে পড়েছেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, কয়রাবাসীর প্রয়োজন টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বস্ত করেছেন কয়রাসহ উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। এখানে ভালো ফসল হয়, মাছ চাষ হয়। টেকসই বাঁধ নির্মাণ হলে কয়রার মানুষের আর ত্রাণের দরকার হবে না।