কিটো ভাইয়ের গল্প
by নওরিন আক্তারচারদিকে যখন কেবলই আতঙ্ক আর হতাশার খবর, ঠিক তখনই মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে নেটিজেনদের সামনে হাজির হয়েছিলেন তিনি। সেই হাসি ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে ও সাহস জোগাতে প্রয়াস চালিয়েছেন একের পর এক। বলছি কিটো ভাইয়ের কথা। তার আসল নাম মাসরুর রাব্বি ইনান। পড়াশোনা করছেন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ নিয়ে, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)।
‘কিটো ভাই’ নামকরণের রহস্য জানালেন ইনান। তখন কেটোজেনিক ডায়েটের বেশ কদর স্বাস্থ্য সচেতনদের কাছে। পরিবারের অনেকেই এই ডায়েট মানছেন, খাদ্যরসিক ইনানের ওপরও এ সংক্রান্ত চাপ বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু নিজের স্বাস্থ্য বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিন্দুমাত্রও চিন্তিত নন ইনান। বরং ভাতপ্রেমী হওয়ার কারণে কিটো ডায়েট মেনে চলাটা এক ধরনের অত্যাচারেরই সামিল তার কাছে। কারণ এই ডায়েট মানতে হলে ভাতের পাশাপাশি সব ধরনের কার্বোহাইড্রেটের কথা ভুলে যেতে হবে। এরই মধ্যে ইনানের মামা কিটো ডায়েট মেনে ১২ কেজি ওজন ঝরিয়েছেন এই খবরে উঠেপড়ে লাগলেন বাকি সদস্যরা। ভাতের বদলে সামনে আসতে শুরু করলো পিনাট বাটার, আপেল সিডার ভিনেগার, বিভিন্ন ধরনের সবজি। এরপরই বিপ্লবী হয়ে উঠলেন ইনান। যারা ডায়েটের নামে পছন্দের ভাত খেতে বাধা দেন কিংবা শারীরিক আকৃতি নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কথা বলেন, তাদের বিরুদ্ধে মনের কথা জানিয়ে ছোট্ট একটি ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দিলেন ফেসবুকে। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার সেই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। ভাত খেতে পছন্দ করেন এমন মানুষ যেমন শেয়ার দিলেন, তেমনি যারা কিটো ডায়েট অনুসরণ করছেন তারাও শেয়ার করলেন ইনানের ভিডিওটি। ভিডিওতে পড়তে শুরু করলো হাজার হাজার মন্তব্য। এরমধ্যে একজন ইনানকে ‘কিটো ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। ইনানেরও ভালো লেগে যায় নামটি। ব্যস! এই নামেই এরপর থেকে তিনি নেটিজেনদের কাছে আসতে শুরু করেন মজার মজার সব ভিডিও নিয়ে।
এরমধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে সাধারণ ছুটি শুরু হয়ে যায় দেশে। কিন্তু অনেকেই মানছিলো না সামাজিক দূরত্ব। এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে সচেতন করতে কী করা যায় ভাবছিলেন ইনান। বারবার হাত ধোয়া উচিৎ, বাইরে যাওয়া উচিৎ না- এই ধরনের উপদেশমূলক কথা তখন অনেকেই বলছেন। বাকিদেরটা না শুনে কেন ইনানেরটাই সবাই শুনবে? ভাবলেন, তথ্যগুলো এমনভাবে দিতে হবে যেন মানুষ আনন্দের সঙ্গে সেগুলো গ্রহণ করে। এমন ভাবনা থেকে মাত্র দশ মিনিটে নিজেই লিখে ফেলেন ‘কিটো স্টে হোম সং।’ নিজের উকুলেলে বাজিয়ে গানটি গেয়ে ফেলেন ইনান, ছেড়ে দেন ফেসবুক পেইজের পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে। ‘এ গেদু, সমেস্যা কী? হাতে পায়ে সাবান মাখ, ঘন ঘন ধুইতে থাক...’- বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার গানটি মানুষ এতোটাই পছন্দ করে যে মাত্র আধা ঘণ্টায় হাজার শেয়ার ছাড়িয়ে যায়। সবার মুখে মুখে ফিরতে থাকে গানটি।
এরপর পরবর্তী গান নিয়ে আসেন ইনান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছিল শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি এই সময় মানসিক সুস্থতাও ভীষণ জরুরি। মানুষকে আনন্দ দিতে তাই কিটো ভাই লিখে ফেলেন ‘কিটো হ্যাপি সং।’ ‘এ গেদু ঘরে আছ?’ গানটিতে মানুষকে আনন্দে থাকতে ও হতাশা থেকে দূরে থাকতে বলেন ইনান। এভাবেই একের পর এক কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে ফেসবুকে। বেশ কিছু গানের কভার করেও শ্রোতাদের প্রশংসা পেয়েছেন তিনি।
জানালেন, ছোটবেলায় অল্পস্বল্প গান শিখলেও সেভাবে চর্চা করা হয়ে ওঠেনি কখনও। বিভিন্নভাবে গিটার শিখেছেন নিজের আগ্রহেই। এভাবে শেখা উকুলেলেও।
ভিডিওর জন্য আঞ্চলিক ভাষা বেছে নেওয়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে ইনান জানান, এই ভাষায় খুব সহজে নিজেকে মেলে ধরা যায়। নিজ অঞ্চল বরিশালের ভাষার উপর স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে আলাদা ভালোবাসা। এছাড়া আঞ্চলিক ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের যে দক্ষতা রয়েছে নিজের, সেটি দিয়েই তিনি চেয়েছেন মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে।
কিটো ভাইয়ের প্রতি দিন দিন মানুষের প্রত্যাশা বেড়ে যাচ্ছে, এখন সবাই চান প্রতিদিন ভিডিও আপলোড দেওয়া হোক। এতে দায়িত্বের চাপ বেড়েছে কী? ইনান জানান, ব্যাপারটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন ইনান। যেমন, করোনা যোদ্ধাদের নিয়ে ‘কিটো সুপার হিরো সং’ লিখেছিলেন তিনি। ভিডিওটি প্রকাশের পর অনেকেই অভিযোগ জানান, কেন তাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি গানটিকে। ইনান মনে করেন, এই প্রত্যাশার মধ্যে ভালোবাসা লুকিয়ে আছে অনেকটুকুই। যদিও সবার প্রত্যাশা সমানভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়, তারপরও তিনি চেষ্টা করেন মানুষের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে। অনেকগুলো বিষয়কে মাথায় রেখে তবেই কনটেন্ট বানাতে হয় ইনানকে। জানান, সব বয়সী দর্শকই রয়েছে তার। ফলে ভাষাগত দিক থেকে যেমন থাকতে হয় সচেতন, তেমনি কনটেন্টের বিষয় যেন কাউকে আহত না করে ভাবতে হয় সেদিকটাও। এসব চাপ নিয়েই তিনি একের পর এক বানিয়ে চলেন চমৎকার সব কনটেন্ট। প্রতিটি কৌতুকপূর্ণ কনটেন্টেই রয়েছে কোনও না কোনও বার্তা। ইনান মনে করেন, বর্তমানে ভাইরাল হওয়া বেশ সহজ। কিন্তু গতানুগতিকভাবে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করাটা যেমন অসম্মানের, তেমনি এ ধরনের চেষ্টাকারী হারিয়েও যায় খুব সহজে। ইনান মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে চান, মানুষকে হাসিয়ে আনন্দ পেতে চান।
এছাড়াও ভবিষ্যতে ‘সল্যুশন ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রজেক্ট শুরু করার ইচ্ছে আছে বলে জানান ইনান। এ প্রজেক্ট কাজ করবে সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, মূলত সেটা থেকেই কাজ করতে চান তিনি। পড়াশোনার বিষয়কেও এই কাজে লাগাতে চান। এছাড়া নিজের ব্যান্ড ‘এলেবেলে’ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সুযোগ পেলে রূপালি পর্দায় অভিনয়ের ইচ্ছের কথাও জানান কিটো ভাই।