https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2020/05/25/7ff3b67dbb926b87f95823a2237fc58e-5ecbce47086d9.jpg
অংলকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সব ভুল হয়ে যায়

by

‘ফলিত বাংলা সাহিত্য ও অ্যাপ্লায়েড হিস্টরি’। চোখ বন্ধ করে লিখে দিলাম।

আমার সদ্য পরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে কথা লিখছিলাম ম্যাসেঞ্জারে। কথায় কথায় তিনি আমার পড়াশোনার বিষয় জানতে চাইলে আমি চোখ বন্ধ করে লিখে দিয়েছিলাম ‘বাংলা সাহিত্য ও অ্যাপ্লায়েড হিস্টরি’। ওপার থেকে টুং করে একটা প্রশ্নবোধক আর একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন চলে এল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ভুল হয়ে গেছে। বোঝেনই তো, চারদিকের অবস্থায় মাথা ঠিক নেই। কিছু মনে করবেন না। এরপর আর কথা ও লেখা এগুলো না।

লকডাউনের দীর্ঘ সময়ে এমন ভুল হয়েই যাচ্ছে। ঠেকানো যাচ্ছে না। একদিন উত্তেজিত হয়ে এক আন্তর্জালীয় বন্ধুকে লিখে দিয়েছিলাম, এই কোরোনা কালি, কেমন আছ? তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, মরণ! আমি ততোধিক উত্তেজিত হয়ে লিখলাম, ইয়াপ। নরম। তিনি আমাকে ব্লক করে দিলেন। ব্লক খেয়ে আমার মনে হলো, ম্যাসেঞ্জারের ওপাশে যিনি বসেছিলেন, তিনি একজন নারী। তাঁকে ‘কোরোনা কালি’ বলাটা আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি যে তাঁকে বলতে চেয়েছিলাম, এই করোনাকালে কেমন আছ, সেটা এখন তাঁকে বোঝাব কীভাবে?

লকডাউনের দীর্ঘ এই সময়ে মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হয়েছে প্রয়োজনীয় এটাসেটা কেনাকাটার জন্য। যত টাকাই পকেটে নিয়ে গিয়েছি, তার সবই খরচ হয়েছে, এক টাকাও ফেরেনি। এ জন্য তো আর কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি! এমনও হয়েছে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হয়েছে দীর্ঘপথ। আচ্ছা বলুন তো, এক হাজার টাকার বাজারে পাঁচ টাকা কোন চুলোয় গিয়ে পুড়ছে, তার হিসাব রাখা কি অত সহজ? একদিনের ঘটনা বলি।

নাকে-মুখে মাস্ক গুঁজে আর হাতে সস্তার দস্তানা পরে চোখে একটা কিম্ভূত প্লাস্টিকের চশমা লাগিয়ে বাজারে উপস্থিত হলাম। দুপুর বেলা। লোকজন এমনিতেই কম থাকে। রোজার কারণে লোক আরও কম। মোটামুটি বড় সাইজের একটা মাছ কিনে ফেললাম। মাছ বাজারের পাশে সামাজিক দূরত্ব বাঁচিয়ে যে নারীটি ইয়া বড় বটি নিয়ে বসে কেজি দামে মাছ কুটে দেন, তাঁর সামনে হাজির হলাম। তাঁকে দেখলেই আমার বুক কাঁপে। সেটা বটির সাইজ দেখে নাকি তাঁর দারিদ্র্য–জীর্ণ লাবণ্য দেখে, তা বলা আমার পক্ষে মুশকিল। আমি তাঁর পুরোনো খদ্দের। তাই তিনি মুফতে একটা হাসি দেন আমাকে দেখলেই। কোনোমতে মাছ তাঁর হাতে গুঁজে দিতেই তিনি দক্ষ হাতে সেটার এফোঁড়–ওফোঁড় করতে থাকলেন। আমি সামাজিক দূরত্ব মেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম।

দুপুরের খররোদের প্রচণ্ড তাপে ঘামছি। মাছ কোটা শেষ হলে তিনি ব্যাগে ভরে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি দামের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে দিলাম এই ভেবে যে লকডাউনে বেচারির ব্যবসাপাতি কম। নিক না একটু বেশি। টাকা দেখে তিনি অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই সময় টুক করে ঘামের নোনতা জল ঢুকল আমার বাম চোখে। আমি বাম চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তিনি ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, যান যান। বাড়ি যান। আমি সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, সরি! তিনি বললেন, সরেন। আমি পারুম না। পেছনে দেয়াল। সরনের জায়গা নাই। বলেই, ডান চোখ বন্ধ করে দিলেন। ভাবলাম, ভুল শুধু আমারই হচ্ছে না। আরও অনেকের হচ্ছে। হ্যাঁ, সেদিন টাকা কিছু বেশি…ওই আরকি, দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এক চোখ বন্ধ করার জন্য নয়।

মধ্যরাতের উদ্দামতায় মেসেঞ্জারে কথা লিখছি। বান্ধবীর বেশি কিছু হওয়া এক ‘প্রাক্তনে’র গোপন কুঠুরিতে একটা নির্দোষ জোকস লিখলাম।
‘আমার সঙ্গে একটা খেলা খেলবে?
নিয়মটা বলো।
আমি চোখ বন্ধ করব আর তুমি আমার জীবন থেকে চলে যাবে। আর কোনো দিন ফিরবে না।’

সেন্ড করলাম। বসে আছি। দেখলাম সিন হয়েছে আমার জোকস। কী উত্তর আসে দেখার জন্য বসে আছি উত্তেজনা নিয়ে। মাথায় গাট্টা পড়ল। ভীষণ অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখলাম, তিনি। আঙুল দিয়ে দরজা নির্দেশ করে বললেন, দরজায় তালা নেই।

সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, আগুনের গোলা শুধু পোলারাই নয়।

সে রাতে কী হয়েছিল, সেটা জানার দরকার নেই। কিন্তু আমি ভাবছি, এত বড় ভুল হলো কীভাবে! ব্যাপক নকলবাজির যুগে নকল করেই তো পরীক্ষা পাস করেছি। ম্যাজিস্ট্রেট, টিএনও, এসি ল্যান্ড কারও সাধ্য হয়নি আমাকে ধরার। আর এই মেসেঞ্জারে ধরা খেয়ে গেলাম! রাতে নারকেলগাছ সাফ করে পরদিন ব্যাপক উদ্দীপনায় চোর ধরতে বেরিয়েছি, নিজে ধরা পড়িনি। বাপ-মার কত পকেট কেটেছি। ধরা পড়িনি। কিন্তু আজ? এই লকডাউনের মধ্য রাতে? সময় লেগেছিল একটু; মানে ম্যানেজ করতে।

২.
নতুন একটা শব্দ শিখেছি। কোয়ান্টাম টুইন। শব্দটির সানেনুজুল আমি জানি না। কিন্তু ব্যাপারটাকে উদাহরণ দিয়ে বোঝালে বেশ চমৎকার লাগে। ধরুন, আমি ট্রাম্প সাহেবের কোয়ান্টাম টুইন। তিনি প্রতিদিন যে রাজকীয় নাশতা সারেন, ঢাকায় বসে সেই নাশতায় আমার পেট ভরে, স্বাদসহ। অথবা ধরুন, আমি পুতিন সাহেবের কোয়ান্টাম টুইন অথবা বিল গেটস সাহেবের। মধ্যাহ্নভোজে তাঁরা যা খান, তাতে আমি তৃপ্ত হই, স্বাদ-গন্ধসহ ঢাকায় আমার ভাড়া বাসায় বসে।

এ তো গেল খাওয়ার ব্যাপার। ঈদের দিন তো, একটু ভালো কাপড়চোপড় পরব না কিংবা সেন্ট-পারফিউম মাখব না? এবার ধরুন পোশাক-আশাক, সেন্ট-পারফিউমের জন্য আমি নায়ক-নায়িকাদের কোয়ান্টাম টুইন বানালাম। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর পোশাক আর সেন্ট-পারফিউমগুলো তাঁদের দখলে। আর ঈদের দিন ভক্তদের সামনে নিজেদের ইমেজ ঠিক রাখতে তাঁরা নিজেদের সংগ্রহের সেরা সেরা পোশাক, সেরা সেন্ট-পারফিউম ব্যবহার করবেনই। আমি শুধু সময়মতো কখনো শুভ, কখনো পরীমনি অথবা কখনো শাহরুখ খানকে পছন্দ করে নেব। আর যখন যাঁকে পছন্দ করব, তখনই তাঁর পোশাক আমার শরীরে ফিট করে লেগে যাবে, আমার শরীর থেকে তাঁদের সেন্ট-পারফিউমের সুগন্ধ ভুর ভুর করে ছড়িয়ে পরবে কোনো দুই নম্বরি ছাড়াই। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই কেমন উত্তেজিত বোধ করছি।…

এবার ধরুন, এই লকডাউনময় পৃথিবীতে, আম্পানের ছোবলে বিপর্যস্ত লাখ লাখ অভুক্ত, পোশাকহীন আবালবৃদ্ধবনিতা ভুলক্রমে যদি আমাদের কোয়ান্টাম টুইন হয়ে যায়

ভাববেন না। বিজ্ঞান এখনো অতদূর এগিয়ে যায়নি। নিশ্চিন্তে থাকুন।

৩.
খেয়াল করেছেন, এখন ঈদ কিংবা ইদ যাই লিখুন, ভুল হয় না।
আজ ঈদ। আনন্দের দিন। ভুলময় পৃথিবীতে এক দিনের জন্য হলেও আনন্দ করুন।