শোলাকিয়ার সবুজ ঘাসে যেন ‘বেদনার অশ্রু’
by নূর মোহাম্মদএ যেন অবিশ্বাস্য মুহূর্ত। এমন শূন্যতা কেউ দেখেনি আগে। পৌনে তিন’শ বছরের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ঈদের দিনে নির্জনতা উপ-মহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে।
লাখো মানুষের পদচারণায় মুখর থাকার কথা ছিল এ ময়দান। ঈদের দিন ভোর থেকে বিশালায়তনের এ ঈদগাহ ঘিরে চোখে পড়তো প্রশাসনের প্রস্তুতি যজ্ঞ। ঈদের আগের দিন থেকে দেশ- বিদেশের মুসল্লিদের মাঠে অবস্থান, রাত্রি-যাপন। তবে এবারের ঈদে ইতিহাসের নতুন সাক্ষী হয়ে থাকলো শোলাকিয়া।
মহামারি করোনা বদলে দিয়েছে ২৭০ বছরের ইতিহাস। এই প্রথম বারের মতো নির্জনতা নিয়ে একটি ঈদের সকাল পার করলো শোলাকিয়া। করোনা মহামারি বদলে দিয়েছে শোলাকিয়ার শত শত বছরের ঐতিহ্য। যুগের পর যুগ নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাক কেটেছে। তবে বন্ধ হয়নি শোলাকিয়া মাঠের ঈদের জামাত। এমনকি জামাত শুরুর আগে ইতিহাসের বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার সময়েও হয়েছে ঈদের জামাত।
একদিকে পুলিশের সাথে জঙ্গিদের বন্দুকযুদ্ধ চলছে, অন্যদিকে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঈদের নামাজ। তবে এইসব আজ ইতিহাস।
বাস্তবতা হচ্ছে, বৈশ্বিক করোনা মহামারির জন্য এবারই প্রথম শোলাকিয়া মাঠে ঈদের জামাত হয়নি। ঈদকে ঘিরে ঈদগাহ ময়দান ও আশপাশে ছিল না সংস্কার আর শোভার্বধনের চাকচিক্য। বরং নিরানন্দ আর মলিনতা নিয়েই একটি ঈদুল ফিতর পার করলো শোলাকিয়া। বিশাল এ প্রান্তরের সবুজ ঘাসে যেন বেদনার অশ্রুর মতোই জমে ছিল ভোরের জলকণা।
শোলাকিয়ায় জামাত না হওয়ায় কিশোরগঞ্জ যেন অচেনা-অজানা এক জনপদ। সাধারণত ঈদের দিন ভোর থেকে সারা শহর থাকতো হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর।
আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর গাড়ি বহরের ইর্মাজেন্সি হুইসেল, ট্রাফিক পুলিশের ঘাম ঝরা অবস্থান আর দেশ-বিদেশের সংবাদকর্মীদের কর্মব্যস্ততা থাকতো ঈদের সকালে। এবার তার কিছুই ছিল না।
শোলাকিয়া ঈদগাহে এবার ছিল ১৯৩তম ঈদুল ফিতরের বড় জামাত।
ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী জানান, ‘ আমি কিশোরগঞ্জে যোগদানের পর থেকে সভাপতি হিসেবে চারটি ঈদের জামাত পেয়েছি। এবারই প্রথমবার মনে হচ্ছে একটা শূন্যতা। ঈদের দিনে শোলাকিয়া নিরব থাকবে, শহর থাকবে নির্জন.. এর আগে কোনো দিন এমনটা মনেই হয়নি'।
তিনি আরও জানান, লোক সমাগম এড়াতে মাঠের সব কটি গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের মসজিদটিও বন্ধ রাখা হয়।
১৯২ বছর আগে শুরু শোলাকিয়ায় ঈদের বড় জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এরও দুইশ বছর আগে থেকে এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠানে নেয়া হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরে দেশ-বিদেশের তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মুসল্লি একসঙ্গে শোলাকিয়ার বিশাল প্রান্তরে নামাজ পড়েন। এখানে একটি মাত্র জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
বিশাল প্রান্তের সব মুসল্লি যাতে নামাজ শুরুর মুহূর্তটি জানতে পারেন এ জন্য নামাজ শুরুর আগে বেশ কয়েকবার বন্দুকের গুলি ছোঁড়া হয়। সবশেষ জামাত শুরুর এক মিনিট আগে গুলি ছুঁড়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতি ঘোষণা করা হয়।
লাখো মুসল্লির নিরাপত্তায় নেয়া হতো চার স্তরের নিরাপত্তা। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশসহ বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন থাকে মাঠের চারপাশে। জামাত ঘিরে পুরো শহর যানবাহন শূন্য করে সাজানো হয় ট্রাফিক ব্যবস্থা। আকাশে নজরদারি করে উন্নত ক্যামেরা যুক্ত ড্রোন। দূরের মুসল্লিদের জন্য ময়মনসিংহ ও ভৈরব বাজার থেকে চলাচল করে দু’টি বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। তবে এবার সব আয়োজন থামিয়ে দেয় অদৃশ্য করোনাভাইরাস।
বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপশালী বীর ঈশা খাঁর ১৬তম বংশধর দেওয়ান মান্নান দাঁদ খান ১৯৫০ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহটি ওয়াকফ্ করেন। তারও দুইশ বছর আগে থেকে শোলাকিয়া মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে উল্লেখ আছে ওই ওয়াকফ দলিলে।
১৮২৮ সালে ঈদুল ফিতরের বড় জামাতে এ মাঠে প্রথম ১ লাখ ২৫ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। সেই থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়ালাখিয়া’, যা এখন শোলাকিয়া নামে পরিচিতি।
২০১৬ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। দুই পুলিশ সদস্যসহ নিহত হন বেশ কয়েকজন। তবু থেমে থাকেনি ঈদের জামাত। তবে এই প্রথমবারের মতো ঈদের দিনেও নিরব থাকছে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া।