এখন নজরুল কণ্ঠে কণ্ঠ মেলানোর দিন

by

করোনাক্রান্ত মুমূর্ষু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে নজরুলকে স্মরণ করতে হয় অনিবার্য কারণে। তিনি আর্ত-পীড়িত মানুষের ছিলেন আপনজন। ১৯১৯ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে যুদ্ধে যোগদানকারী আজন্ম স্বাধিকারকামী নজরুল কলকাতায় ফিরে এসে প্রথমে বন্ধু শৈলজানন্দের বাদুড়বাগামের মেসে ওঠেন। উল্লেখ্য, এখানেই একদা বিদ্যাসাগরের একখানা বাড়ি ছিল, তারপর চলে আসেন সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃত্ মুজাফফর আহমদের আস্তানা, ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের দোতলায়। ভাবনা হয়তো অমূলক নয়, সমাজ পরিবর্তনের পুরোধার সান্নিধ্যে এসে তাঁর মানসিক পরিবর্তন ঘটে এবং মানুষের অধিকার ও মানব মহিমা কীর্তনে মুখর হন। আসলে ছকে বাঁধা কোনো মতাদর্শের নিগড়ে তিনি বিলীন হয়ে যাননি। মানবানুভূতির সকল তন্ত্রী তাঁর ঝংকৃত হয়েছে পক্ষপাতহীনভাবে। মহত্ প্রতিভার পরিচয় বোধ করি এই অনুভবের মধ্যেই নিহিত। তা ছাড়া একরৈখিকতা তাঁর চরিত্রের অনুকূলে ছিল না।

আমরা বলছিলাম নজরুলকে স্মরণ করার কথা। কেবল ১১ই জ্যৈষ্ঠকে সামনে রেখে নয়, সার্বিক বিশ্বপরিস্থিতির ভয়ংকর রূপ থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তা উপলব্ধির জন্য। কেননা ঈদ সামনে রেখে নজরুল যে গান রচনা করেছিলেন—‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, তা ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে।

মানবতা লুণ্ঠিত হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে, বিচিত্র ধারায়। সমকালীন জীবন ও জগেপ্রমী মানুষ অবহেলিতদের সমব্যথী হয়েছেন। এখনো হন। তবে নজরুল ইসলামের সমবেদনা লোকরঞ্জক কিংবা শখের ছিল না। তিনি জীবন দিয়েই বুঝেছিলেন, ‘মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষের অপমান’ প্রত্যক্ষ করে। মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত সুখ-ঐশ্বর্যের চেয়ে সামষ্টিক মুক্তির প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। ধর্ম-বর্ণ-দেশ-কাল নয়, ‘জাতের চাইতে মানুষ সত্য’—এটাই ছিল তাঁর কাছে বড় পরিচয়। তাইতো তিনি শৌখিন কবিতা-প্রাসাদ নির্মাণ না করে অবহেলিত মানুষের মুক্তির জন্য ‘রক্তলেখা’ রচনা করে গেছেন। তিনি দারিদ্র্যকে ‘মহান’ বলেছেন, কারণ তার কবলে পড়েই ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ লাভ করেছিলেন।

সারা বিশ্ব করোনাপীড়িত, উত্কণ্ঠিত। ক্ষমতাদম্ভীদের ‘খাহেশ’ চরিতার্থের বলি হিসেবে মানুষ আজ অদৃশ্য ভাইরাসের শিকার। এর মূলে শক্তিধরদের প্রকৃতির ওপর ‘বলাত্কার’। নজরুল ইসলাম ব্যভিচারীদের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ আক্রোশে ‘সর্বহারা’ কাব্যের ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় বলেছিলেন :

‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে। এই ধরণির যাহা সম্বল,/বাসে ভরা ফুল, রসে ভরা ফল, সুস্নিগ্ধ মাটি, সুধা-সম জল, পাখির কণ্ঠে গান,—সকলের এতে সমঅধিকার’, নজরুলের এই ক্ষোভ কোনো মতবাদের বহিঃপ্রকাশ নয়, স্বতঃস্ফূর্ত জীবন ও জগেপ্রমীর আর্তনাদ। দেখা যায়, প্রায় সমসাময়িক কালে কবি ইকবাল মনুষ্যত্বের অপমান দেখে ‘শিকওয়া’য় জানাচ্ছেন : ‘নালে বুলবুলকে শুনো আওর হামওয়াতানে গোস রাহোঁ’! না, নীরব থাকবেন না, অভিযোগ করবেন, করেছেনও। কবি-দার্শনিকরা যুগে যুগে সহজাতভাবে প্রতিবাদ করে গেছেন। ইতিহাসের কঠিন সত্য, কেউ কারো সুপরামর্শ শোনেনি। শুনলে অধিকাংশ মানুষ গৃহবন্দি, আর অনেক কর্মহীন মানুষ অনাহারী থেকে করোনাছোবলের আগে মৃত্যুপ্রতীক্ষা করত না।

সরকার দুস্থদের ত্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে, সাধ্যমতো। সেগুলো বিতরণের ভার নজরুলের ভাষায় কিছু ‘লোভী’ আর ‘শয়তান’ পেয়েছে। নজরুলের ফরিয়াদ : ‘তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী।’ রবীন্দ্রনাথ মৃদু অথচ কঠিন স্বরে প্রশ্ন রেখেছেন : ‘তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল!’ ক্ষমা কিংবা ভালোবাসা দূরে থাক, এরা ঘৃণারও অযোগ্য! অথচ এরাই জয়ী হয়ে এসেছে অনাদি কাল ধরে। ওমর খৈয়াম তাই মানবজীবনের করুণ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন : ‘হে দুর্জ্ঞেয়, সুবিশাল নির্ভীক গগন দুঃসাহসী, হে চক্রী মহান। ফেলিয়া দিয়াছ মোরে/নির্বিচারে ধূলিপরে রুধিরাক্ত প্রাণ—বারংবার হয়েছি আহত/ছিন্নপক্ষ অসহায় বিহঙ্গের মত।’ জগেজাড়া এই মানব-দুর্দিনে কিছু মানুষের ‘লোভ’ নেপথ্যের ক্রীড়নক। নজরুল ইসলামের কণ্ঠ সরব থাকলে আর দীর্ঘায়ু হলে কী উচ্চারণ করতেন সে কল্পনার বিস্তার না ঘটিয়ে আমরা তাঁর ফরিয়াদ উচ্চারণ করে বলি :

‘তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বি সকলে করিব ভোগ,—কেননা, এই পৃথিবীর নাড়ীর সাথে আছে সৃজন দিনের যোগ’। এই যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়নি। ক্ষমতা মদে মত্ত কিছু মানুষ অধিকাংশ মানুষকে বঞ্চিত করে চলেছে চিরকাল। কবি তাঁর লেখায় এদের ‘সর্বনাশ’ কামনা করেছিলেন। তা কার্যকর হয়ে ওঠে না। কবির প্রেরণায় একজন এগিয়ে এলে অন্যজন পিছিয়ে গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের ডেরায় যোগ দেয়। উদ্দেশ্য, ‘নগদ যা পাও, নাক ডুবিয়ে খাও’। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। নতুবা ‘মানবতা’ শব্দটি উচ্চারণ করার অধিকার আমাদের থাকার কথা নয়। আর ওই যে শ্লাঘাময় পঙিক্ত : ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়’, চিরকাল কেতাবেই থেকে যাবে।

করোনা যন্ত্রণার মাঝে পড়েছে ঈদ আর নজরুল স্মরণের কালক্রম। কবির ভাষায় : ‘মোর অধিকার আনন্দের নাহি নাহি!’ বলে আমরা সান্ত্বনা খুঁজব না। সংকল্প গ্রহণ করব দানবের বিদায় আর শাশ্বত সুন্দর জীবন।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ