হার না মানার গল্প
'ভিয়েত কং' যুদ্ধ আর দুই শব্দে ফেরা
by রাজ শুভ নারায়ন চৌধুরী, ঢাকাকরোনার দিনে এত আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবরে মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর চেয়ে কিছু অনুপ্রেরণার গল্প শুনলে কেমন হয়? আঘাত, চোট, বদভ্যাস থেকে ফিরে আসার গল্প তো অনেকই আছে খেলার জগতে। তার পঞ্চম ও শেষ পর্বে আজ দুই কিংবদন্তির গল্প – বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী ও বাস্কেটবল কিংবদন্তি মাইকেল জর্ডান
যুদ্ধ চাননি বলে
দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম! তাঁর এই দাবি নিয়ে তর্ক করার মতো কাউকে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
প্রতিটি লড়াইয়ের আগে প্রতিদ্বন্দ্বীকে তেতো কথার তোড়ে ভাসিয়ে দিতেন ঠিকই, কিন্তু মোহাম্মদ আলী তো সেসব কথার মান রেখেছেন বক্সিং গ্লাভস হাতেও। ম্যাচপূর্ব সব অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করে সনি লিস্টনকে হারিয়ে মোহাম্মদ আলী – বা সে সময়ের কাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র যখন দাবি করেন, 'তোমাদের কথাগুলো গিলে ফেলো! আমিই সর্বকালের সেরা। বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছি আমি। পৃথিবীকে রাঙিয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুন্দর আমিই', প্রশ্রয়ের চোখে তা মেনে নেন সবাই।
মোহাম্মদ আলী কী, তা হয়তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বক্সিং ছাপিয়ে সব খেলা মিলিয়েও সর্বকালের সেরা কিংবদন্তিদের ছোট্ট তালিকায় আসবে তাঁর নাম। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড সাময়িকী ২০ শতাব্দীর সেরা অ্যাথলেটের স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি বক্সারকে, বিবিসির চোখে তিনি শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব।
তবে সে পথটা শ্বাপদসংকুল ছিল না, সে দাবি আলীর পাঁড় বিষোদগারও করবেন না। বড় হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের চরম মাত্রা দেখে। কথিত আছে, ১৯৬০ রোম অলিম্পিকে লাইট হেভিওয়েটে যে সোনার পদকটা পেয়েছিলেন, সেটি ওহাইও নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র একটি শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে তাঁকে সম্মান দেওয়া হয়নি বলে। যদিও সে দাবির বিপক্ষেও বলেন অনেকে।
আলীর বয়স তখন মাত্র ১৮, তখনো অবশ্য নাম তাঁর আলী হয়নি। সেটি হয়েছে ১৯৬১ সালে তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর। এই ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে বিরোধের কারণে যুদ্ধে যাননি বলেই ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ের বড় একটা অংশ বক্সিং থেকে দূরে থাকতে হয়েছে আলীকে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধে রত। নিজের ১৮তম জন্মদিনে ড্রাফটে (সামরিক বাহিনীতে সেবা দেওয়ার অঙ্গীকার) সই করায় আইন অনুযায়ী আলী যুক্তরাষ্ট্রের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যেতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালে যুদ্ধে যেতে অনিচ্ছার কথা জানিয়ে দেন তিনি। দুটি কারণও বলেন। এক, আল্লাহ বা তাঁর বার্তাপ্রেরকের আহ্বান ছাড়া যুদ্ধ পবিত্র কোরআনের নির্দেশনার সঙ্গে যায় না। দুই, তাঁর কাছে যে দেশটির নাম 'ভিয়েত কং' সে দেশটির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো ঝামেলা নেই বলে জানিয়ে দেন আলী। বলে দেন, ভিয়েত কং-এর কেউ তো তাঁকে 'নিগা' (কৃষ্ণাঙ্গদের অবজ্ঞা করা বোঝাতে যে নামে ডাকা হয়) ডাকে না।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এসব মানবে কেন! ড্রাফট থেকে সরে আসার দায়ে আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের জেল ও ১০ হাজার ডলার জরিমানা করে। একই দিনে তাঁর বক্সিং লাইসেন্স আর পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়া হয়। একটা বন্ডে সই করে আপিলের রায় আসা পর্যন্ত সাজা থেকে মুক্তি পান আলী। সুপ্রিম কোর্ট থেকে সেই আপিলের রায় আসতে আসতে ১৯৭১ সাল! রায় আলীর পক্ষেই এসেছে। শুধু আলীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তাঁর বক্সিং ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময়। ১৯৬৭ সালের মার্চ থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর – ২৫ বছর বয়স থেকে প্রায় ২৯ বছর বয়স এই সময়টাতে – কোনো ফাইট করতে পারেননি আলী।
সেখান থেকে যখন ফিরে এলেন, ততদিনে জো ফ্রেজিয়ার আর জর্জ ফোরম্যান বক্সিং রিং মাতিয়ে চলেছেন। গ্রেটদের সারিতেও তরতর করে উঠে আসছিলেন। কিন্তু বিরতি আলীর বক্সিংয়ে কিছুটা ভাটা ফেললেও মরিচা ধরাতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ, জো ফ্রেজিয়ারের বিপক্ষে 'ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরি'তে ক্যারিয়ারের প্রথম হার দেখেছেন ঠিকই, কিন্তু এরপর আরও দুবারের লড়াইয়ে ফ্রেজিয়ারকে ঠিকই হারিয়েছেন আলী। আর ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর দেখিয়েছেন চমক। শেষের আগে আরেকবার রেখে যান কিংবদন্তির স্বাক্ষর।
জর্জ ফোরম্যানের বিপক্ষে 'রাম্বল ইন দ্য জঙ্গলে' নামার আগে আলীই ছিলেন বাজির দরে পিছিয়ে। তাঁর বয়স তখন ৩২, গতি-রিফ্লেক্স কমে গেছে অনেক। অন্যদিকে আলী এর আগে যাঁদের সঙ্গে জিততে কষ্ট হয়েছে, সেই ফ্রেজিয়ার আর কেন নর্টনকে সহজেই হারিয়েছেন ফোরম্যান। পাল্টা আক্রমণের দারুণ উদাহরণ রেখে হারিয়ে দিয়েছেন ফোরম্যানকে। পরে ফোরম্যান বলছিলেন, 'আমি ভেবেছিলাম আলীকেও হয়তো নকআউট করে দেব। ওর চোয়ালে বেশ জোরে মেরেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে ধরে কানে কানে বলল, 'এতটুকুই তোমার ক্ষমতা, ফোরম্যান?'' বুঝতে পারলাম আমি যেমন ভেবেছিলাম ও তার চেয়েও অনেক শক্ত।'
আর ৯ দিন পর কিংবদন্তির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।
ফিরেও থ্রি-পিট
তাঁর দুই শব্দের একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি – "I'm back!" মাঝে দুই বছরের বিরতি কাটিয়ে বাস্কেটবলের সঙ্গে আবার মিলন খেলাটার তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরার। মাইকেল জর্ডান আবার ফিরেছিলেন বাস্কেটবলে।
চলে যাওয়া যেমন হঠাৎ করে, ফেরাও তেমনি। ১৯৯৩ সালের কথা। ততদিনে শিকাগো বুলসের হয়ে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ – টানা তিন বছর এনবিএতে চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার থ্রি-পিট একদফা হয়ে গেছে তাঁর। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ১৯৮৪ ও ১৯৯২ অলিম্পিকে সোনার পদকও এসে গেছে। এরপরই হঠাৎ 'এয়ার জর্ডানে'র মনোজগতে বদল! ১৯৯৩ সালের ৬ অক্টোবর জর্ডান জানিয়ে দিলেন, বাস্কেটবল থেকে অবসর নিচ্ছেন। কারণ? আর ভালো লাগছে না খেলাটা। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৩০ পেরিয়েছে।
১৯৯৮ সালে তাঁর আত্মজীবনী 'লাভ ফর দ্য গেইম'–এ জর্ডান জানিয়েছিলেন, ১৯৯২ সালের গ্রীষ্মেই অবসরের ভাবনাটা এসেছিল তাঁর মনে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ১৯৯২ অলিম্পিক জেতা সেই 'ড্রিম টিমে'র হয়ে খেলতে গিয়ে যে ধকল গেছে, সেটি খেলাটা নিয়ে, তাঁর আকাশচুম্বী সেলেব্রিটি পরিচয় নিয়ে বিতৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল জর্ডানের মনে।
আরেকটা কারণও ছিল। ১৯৯৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত 'আ হাম্বলড জর্ডান লার্নস নিউ ট্রুথস' শিরোনামের প্রতিবেদনে যেটি বলেছিলেন জর্ডান। কারণটা তাঁর বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু। তিন মাস আগে, ২৩ জুলাই নর্থ ক্যারোলাইনাতে দুই তরুণ গাড়ি ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন জর্ডানের বাবা জেমস জর্ডান। তাঁর মৃতদেহটা ফেলে রাখা হয়েছিল এক ডোবায়, যেটি উদ্ধার হয়েছিল ৩ আগস্ট। বাবার খুব আদরের ছিলেন জর্ডান। বাবা কোনো কাজে ডুবে থাকলে আপনাআপনি জিহবাটা বেরিয়ে আসত তাঁর, বল নিয়ে বাস্কেটের দিকে দৌড়ানোর মুহূর্তে যেটিকে পরে নিজের 'সিগনেচার' বানিয়ে নিয়েছিলেন মাইকেল জর্ডানও। সেই বাবার মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে।
আরেকটা কারণের কথাও অবশ্য শোনা যায়, তবে সেটি তেমন ভিত্তি পায়নি। জর্ডানের জুয়ার অভ্যাস ছিল। ১৯৯২ সালেই জর্ডান স্বীকার করেছিলেন, জুয়ায় প্রায় ৫৭ হাজার ডলার খুইয়েছেন। তা তাঁর অবসরের সময় গুঞ্জন উঠেছিল, জর্ডানের জুয়ার বদভ্যাসের কারণে তাঁকে আসলে গোপনে নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাস্কেটবল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এনবিএ কমিশনার ডেভিড স্টার্ন ১৯৯৫ ও ২০০৬ সালে দুবার সেটি অস্বীকার করেছেন। তবু সে সময় গুঞ্জনটা বাজার পেয়েছিল বেশ। ২০১০ সালে ইএসপিএনের প্রামাণ্যচিত্র 'জর্ডান রাইডস দ্য বাস' – এর পরিচালক রন শেলটন বলেছেন, তিনি প্রামাণ্যচিত্রটার কাজ শুরুই করেছিলেন এনবিএ জর্ডানকে নিষিদ্ধ করেছে – এই বিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু পরে জর্ডানকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা তাঁকে এই বিশ্বাস দিয়েছে যে, গুঞ্জনটা পুরোই 'ফালতু কথা।'
জর্ডানের হঠাৎ অবসর যদি বাস্কেটবলকে নাড়িয়ে দিয়ে থাকে, তাঁর যাত্রার পরের ধাপটা আরও চমকে দিয়েছে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে বেসবলে নাম লিখিয়েছিলেন জর্ডান! বাবা কল্পনা করতেন, ছেলে একদিন মেজর লিগ বেসবলে খেলবে। মাইনর লিগ বেসবল দিয়েই শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাস্কেটবলের সঙ্গে যাঁর আত্মার সম্পর্ক, বেসবলে তাঁর জমবে কেন! ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে মেজর লিগ বাস্কেটবলে খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের সময় আবার ফেরেন বাস্কটবলে। ১৯৯৫ সালের ১৮ মার্চ দুই শব্দের ওই প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে।
ঘোষণার পরের দিনই ইন্ডিয়ানাপোলিসে ইন্ডিয়ানা পেসারসের বিপক্ষে কোর্টে নেমে যাওয়া, সেদিন ১৯ পয়েন্টও এনে দিয়েছিলেন শিকাগো বুলসকে। যুক্তরাষ্ট্রের টিভিতে কোনো অনুষ্ঠানের দর্শকাগ্রহ পরিমাপের রেটিং নিয়েলসেন রেটিং জানায়, পেসারস-বুলস ওই ম্যাচটির রেটিং ১৯৭৫ সালের পর কোনো এনবিএ ম্যাচে ছিল সবচেয়ে বেশি।
তাঁর প্রথম দফা অবসরের পর জর্ডানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া ২৩ নম্বর জার্সিটা অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছিল শিকাগো বুলস। ফেরার পর আবার জার্সিটা গায়ে জড়ানোর সুযোগ ছিল জর্ডানের, কিন্তু তিনি নিলেন ৪৫ নম্বর জার্সি। বেসবলে ওই জার্সিটাই পরতেন কিনা!
তা জার্সি নম্বর বদলেছে, কিন্তু জর্ডান ছিলেন একইরকম। প্রথম দফা অবসর নিয়েছিলেন টানা তিন মৌসুমে এনবিএ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে থ্রি-পিটের রেকর্ড গড়ে। দ্বিতীয়বার যখন ফেরেন, শিকাগো বুলস পয়েন্ট তালিকার মাঝামাঝিতে ধুঁকছিল। কিন্তু জর্ডান ফেরার পর কী হলো? ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ – আরেক দফা শিকাগো বুলসের থ্রি-পিট।