https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2018/06/15/510ebbc6f78e45d3587944825c054872-5b23c0206af13.png?jadewits_media_id=1301191

'চাঁদ তুমি ফিরে যাও'

by

কেমন ছিল ১৯৭১ সালের ঈদ? আমার ছেলেমেয়েরা যখন ছোট, ওরা এমন প্রশ্ন করত। ৭১-এর ঈদ নিয়ে তেমন আলোচনা চোখে পড়ে নাই। পরে অবশ্য জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদ উদযাপনের বর্ণনা পেয়েছিলাম। আমিও সেরকমই বলতাম।

সেবার ঈদ হয়েছিল নভেম্বরে, আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীর দু'দিন পর। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদ, কত মানুষ মরছে, কত মানুষ যুদ্ধ করছে, কত মানুষ কষ্টে আছে, এ সময় আনন্দ করা যায়?

আমার একটা গানের কথা খুব মনে পড়ে। ওই গানটা আর শুনি না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রূপা ফরহাদের গাওয়া সেই গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার মনে ছিল প্রথম তিনটি চরণ,
'চাঁদ তুমি ফিরে যাও
দেখ মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা
রূপালি আঁচল কোথায় রাখবে বলো।'

ঐ গানের কথা সেদিন মনে পড়ল যখন শুনলাম করোনাকালে ঈদের কেনাকাটার জন্য শপিংমল খুলে দেওয়া হচ্ছে। কখন যে কী ঘোষণা আসে, কেন আসে, কিছুই বুঝি না। আমরা তো সেই ১৮ মার্চ থেকে ঘরে আছি। কতদিন থাকতে হবে জানি না। দেশের এই বিপর্যয়ের সময় কিছু নিয়ম মেনে তো চলতেই হবে। এর মধ্যে ঈদের কেনাকাটা! ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তো ঈদ এসেছিল, আমাদেরও তো ছোট বাচ্চা ছিল, কিন্তু আমরা হই-হুল্লোড় করে ঈদ করি নাই। এখনও আমরা আরেকটা যুদ্ধে আছি, শুধু শত্রু অদৃশ্য।
ছোট্ট 'মহারাজা'

করোনা – একটা ছোট অদৃশ্য ভাইরাস, কিন্তু তার শক্তি এত প্রবল যে তার প্রতাপে সারা বিশ্ব প্রকম্পিত। সব রথী মহারথী বিজ্ঞানী রাজা মহারাজা তার কাছে পরাজিত। কোনো অস্ত্র কোনো সৈন্য সামন্ত কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। সে মহাবিক্রমে দিগ্বিজিয় করে বেড়াচ্ছে। সারা বিশ্ব আজ তছনছ হয়ে গেছে। পরে শুনলাম যে 'করোনা' মানে 'মুকুট'। তা এই ভাইরাসের আচরণ রাজার মতই তো। পাগলা রাজা!

সেই ছোট্ট মহারাজাকে বাংলাদেশ মনে হয় একটু অবজ্ঞা করেছে। মনে করেছে, 'এ আর কি করবে আমাদের'! সেই অবহেলাই হয়তো আজ আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। কত লোক কত কষ্টে আছে আল্লাহ জানেন। আমার মনে হয় যে, এদেশের লোক বুঝে উঠতে পারেনি কী করতে বলা হচ্ছে। কোয়ারেন্টিন, লক ডাউন, সামাজিক দূরত্ব – এ ব্যাপারগুলো যদি আরো সহজ করে বোঝানো হতো, হয়ত আরো বেশি কাজ হতো। অনেক শিক্ষিত শহুরে লোক অনেক কিছু না বুঝলেও বাসার দুই গৃহকর্মী তেমন শিক্ষিত না হলেও বেশ বুঝদার! একজন থাকে কামরাঙ্গীর চরে, আরেকজন শাহবাগে বস্তি ঘরে। ৮ মার্চে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হল, আমার মনে হল ওদের মাস্ক আর হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার কিনে দিই। কিন্তু তাতেও কি হবে? ওরা তো বাসে-টেম্পুতে করে আসে, সেখানে তো সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল। যেসব বাসায় কাজ করে সেখানে বিদেশ-ফেরত কেউ আছে কি না তাও তো জানি না। এ সব ব্যাপারে ওদের বলতে ওরা জানালো যে, টিভিতে এসব ওরা শুনেছে, তাই সতর্ক আছে। তবু মনে হল ছুটি দেওয়া উচিৎ।

তখনো স্কুল-কলেজ বন্ধ হয় নাই, কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, দুই গৃহকর্মীকেই ছুটি দিয়ে দেব। কিন্তু ওরা আবার ভাববে না তো যে ওরা বস্তিতে থাকে বলে আমরা ঘৃণা করছি? তাই বোঝালাম যে, ওদের নিজের নিরাপত্তা আর পরিবারের সুরক্ষার জন্যই ওদের ঘরে থাকা দরকার। সেইসঙ্গে আশ্বস্ত করলাম, ওরা বেতন পাবে। জানি আমাদের কষ্ট হবে, তাই বলে তো ওদের এই আপদকালে ছাঁটাই করা যায় না। আগাম বেতন দিলাম, পরের মাসের বেতন বিকাশে যাবে, বলে দিলাম। কিন্তু ওরা যেন অযথা বাসার বাইরে না যায়। বলেছি, যেদিন এদেশ থেকে মহারাজা বিদায় নেবে সেদিন আবার দেখা হবে।

আমি জানতাম যে আমার সমস্যা হবে। বাড়ির সব কাজ করায় আমার উদ্যম সবসময়ই ছিল। এখনো আছে। কিন্তু বয়স এখন ৭৬। এই বয়সে এত কাজ করা কি সম্ভব হবে? ঠিক হবে? ডাক্তারের তো বারণ আছে। কিন্ত কি আর করা, করতে তো হবেই।

তাপস, আমার বড় ছেলে, ঘরের কাজে হাত লাগাচ্ছে তাই চলে যাচ্ছে কোনমতে। তারপরও যা ভালো লাগল তা এই যে, আজ পর্যন্ত আমাদের দুই গৃহকর্মীর কেউ বলে নাই যে মৃত্যু কপালে থাকলে হবে, এত ভেবে কাজ নাই। আমাদের পরিচিত অনেক শিক্ষিত লোককে এ রকম বলতে শুনেছি। আমাদের গৃহকর্মীদের মুখে একবারও তেমনটা শুনলাম না।

দূরে থেকে জুড়ে থাকি
করোনাকালে আরেকটা সুন্দর ঘটনা ঘটল। এপ্রিলের শুরুর দিকে, এক রাতে তাপস এসে বলল, 'আম্মা, ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে।' আমি তখন বারান্দায় গেলাম। কোলাহলময় ঢাকায় ঝিঁঝিঁর ডাক কদাচিৎ শোনা যায়। মনটা কেমন হুহু করে উঠল। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে! তবে গত কয়েকদিনে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। লোকজনের চলাচল বেড়ে গেছে, আওয়াজও। ঈদ আয়োজনের জন্য বোধ হয়। কিন্তু রোজার মাস থেকে এতটুকু সংযম তো শেখা যেত যে, সবসময় সবকিছু করতে নাই। ঘরে থাকাটা তো একটা সংযম। তাই পয়লা বৈশাখ হোক কি ঈদ, আমাদের উচিৎ নিজে সুরক্ষিত থাকা, অন্যকেও রাখা। আমাদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য অন্যের যেন ক্ষতি না হয়।

যেমন এবার ঈদ উদযাপিত হোক, তবে উৎসবের মতো করে না হয় নাই হল। আগামীতে হবে।

আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর আগে, সেই ১৯৭১-এ, এমনই এক দোটানার দিন এসেছিল। সেদিন অনেকে বলেছিল, 'চাঁদ তুমি ফিরে যাও'। আজকেও কি ৭১-এর মতো ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বলব? তা না হয় নাই বললাম। ঈদ এসেছে; তবে এবার না হয় একটু ভিন্নভাবে পালিত হলো ঈদ।

বাইরে ঘোরাঘুরি যেহেতু উচিত হবে না, একে অপরের বাড়ি যাওয়া যেহেতু উচিৎ হবে না, তাই নতুন কাপড় না কিনে বরং সেই টাকায় বিপন্ন মানুষগুলোর সাথে থাকা যায়। বাড়িতে ভালোমন্দ কিছু রান্নাবান্না হতে পারে, ঘরদোর উল্টেপাল্টে সাজানো যেতে পারে, আর জাকাতের পাশাপাশি ঈদের খরচের কিছু অংশ যারা অনটনে আছে তাদের সাথে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। আমি করেছি। তাপস-ও নাকি ঈদ বোনাসের টাকা যুক্ত করেছে ওর একটা প্রজেক্টের সাথে। ইনফরমাল ওই প্রজেক্টের নাম দিয়েছে 'দূরে থেকে জুড়ে থাকি'। এই শিরোনামে একটা গানও আপলোড করেছে ওরা ফেসবুকে। ইংরেজির অধ্যাপক ও, বিভাগের কিছু ছাত্র-ছাত্রী মিলে পুরো গান নাকি বাসায় বসে বানানো। সেদিন শুনলাম। করোনাকালের এই ঈদে তাই শেষ করি ওই গানের চারটি চরণ দিয়ে:
'দূরে যেতে যদি না পারে দু'পা, নদীর মত করে চলো
অন্তর্জালে যদি না ভরে ক্ষুধা, নিজের মত করে বলো
দূরে থেকে জুড়ে থাকি
যেন কাছে কাছে থাকি সারাজীবন ...'

*সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা, বাংলাদেশ