হবিগঞ্জের ১৪ নারী কর্মকর্তা: অনেক বাধা সামলে নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন তাঁরা
by সুমনকুমার দাশ, সিলেটহবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএন) দায়িত্বে আছেন নাঈমা খন্দকার। ছয় বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে তাঁর। কিছুদিনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেবেন। শারীরিক কারণেই এখন তাঁর ঘরে বসে জীবনযাপন করার কথা। অথচ তিনি করোনাকালের পরিস্থিতি মোকাবিলায় চষে বেড়াচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। ছুটে চলছেন মানবতার সেবায়।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (শিক্ষা ও আইসিটি) দায়িত্বে আছেন উম্মে ইসরাত। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে এই নারী নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে মনোবল না হারানো উম্মে ইসরাত করোনাকে পরাজিত করে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।
হবিগঞ্জের হাটবাজার, পাড়া-মহল্লায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করাসহ নানাকাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন ১৪ জন নারী কর্মকর্তা। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে কর্মরত এই নারী কর্মকর্তারা সংকটের সময়টাতে মানবতার সেবায় জীবন ঝুঁকিতে ফেলে কাজ করে চলেছেন।
নাঈমা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, 'ছয় বছর বয়সী মেয়েকে বাসায় গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে সকালে বের হই। রাত-বিরেতে বাসায় ফিরি। এই সময়টাতে এখন নানা রকমের কাজের প্রচণ্ড চাপ। তাই মেয়েকে সেই অর্থে সময় দিতে পারি না। আবার আগস্টের শেষ দিকে আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হবে। কিন্তু কিছুই করার নেই। প্রশাসনিক দায়িত্ব তো সামলাতেই হবে। এ সময়টাই তো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।'
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে চারটি উপজেলায় ইউএনও হিসেবে এখন নারীরা আছেন। পাঁচটি উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) অর্থাৎ এসিল্যান্ড হিসেবেও আছেন নারীরা। ইউএনওদের মধ্যে মাধবপুরে তাসনূভা নাশতারান, বাহুবলে স্নিগ্ধা তালুকদার, শায়েস্তাগঞ্জে সুমী আক্তার এবং আজমিরীগঞ্জে নাঈমা খন্দকার কর্তব্যরত রয়েছেন। অন্যদিকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে লাখাইয়ে সঞ্চিতা কর্মকার, নবীগঞ্জে সুমাইয়া মমিন, মাধবপুরে আয়েশা আক্তার, সদরে মাশফিকা হোসেন এবং বানিয়াচংয়ে ইফফাত আরা জামান ঊর্মি দায়িত্বরত রয়েছেন।
মাঠপর্যায়ের এই কর্মকর্তারা ছাড়াও জেলা প্রশাসনে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দুজন নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা হচ্ছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (সার্বিক) মর্জিনা আক্তার এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) উম্মে ইসরাত। এর মধ্যে উম্মে ইসরাত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি সুস্থ হয়ে কিছুদিন আগে পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা ছাড়াও জেলা প্রশাসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সৈয়দা শামসাদ বেগম, আফিয়া আমীন পাপ্পা ও আমেনা খাতুন নামের তিনজন কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে আফিয়া আমীন ও আমেনা খাতুন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে আফিয়া আমীন পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছেন। হবিগঞ্জের জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে ১৪ জন নারী কর্মকর্তা এখন বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
করোনাকে জয় করে পুনরায় কাজে যোগ দিতে পেরে খুবই খুশি উম্মে ইসরাত। তিনি বলেন, 'করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়েই আক্রান্ত হয়েছিলাম।
তবে মনোবল হারাইনি। সবার দোয়া-ভালোবাসায় বোনাস লাইফ পেয়ে সুস্থ হয়ে পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছি। করোনাকালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পুনরায় কাজ করতে পারছি, সেটাই বড় প্রাপ্তি।' মর্জিনা আক্তার বলেন, 'নারী কিংবা পুরুষ বিষয় নয়। সরকারি দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে সবাকেই পালন করতে হচ্ছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই বড় কতর্ব্য। আমরা সবাই মিলে এখন সেটাই করছি।'
বাহুবল উপজেলায় ইউএনও হিসেবে কর্মরত রয়েছেন স্নিগ্ধা তালুকদার। তিনি জানান, তাঁর বাসায় ষাটোর্ধ্ব অসুস্থ মা রয়েছেন। মায়ের ডায়াবেটিস আর ব্লাড প্রেসার রয়েছে। বিকল্প না থাকায় মায়ের কাছেই তাঁর সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়ের করোনাকালের দিন কাটছে। কাজের চাপের কারণেই এখন ২৪ ঘণ্টার অনেকটা সময় বাসার বাইরে থাকতে হচ্ছে।
বানিয়াচংয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইফফাত আরা জামান জানান, বাসায় তাঁর সাত মাস বয়সী এক ছেলে রয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে ছেলে কিছুটা অসুস্থ। অথচ কাজের চাপের কারণে ছেলের পাশে থাকতে পারছেন না। ছেলে শ্বশুড়-শাশুড়ি আর স্বামীর সঙ্গেই করোনার এই সময়টা কাটাচ্ছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, নারী কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের সন্তান রয়েছে। তাদের বয়স সাত মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আট বছর পর্যন্ত। করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রত্যেক কর্মকর্তা নিয়মিত প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, হাটবাজার নিয়মিত পরিদর্শন, সংশ্লিষ্টদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে কাজ করছেন।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, 'জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত নারী কর্মকর্তারা নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করোনাকালে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। আসলে নারী কিংবা পুরুষ বিষয় নয়, মূল কথা হলো দায়িত্ব পালনে তাঁরা আন্তরিক ও দক্ষ কি না।
সে হিসেবে হবিগঞ্জে তাঁরা (নারী কর্মকর্তা) চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। দিন-রাত একাকার করে এই কারোনাকালে তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁদের মতো আন্তরিক সহকর্মীদের কারণেই জেলায় করোনাযুদ্ধ ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসক হিসেবে তাঁদের এই আন্তরিকতাকে অভিনন্দিত করছি।'