বাসায় বানানো সেমাই দিয়ে তাঁদের ঈদ ও ব্যবসা
by মানসুরা হোসাইন, ঢাকাসেমাই ছাড়া ঈদের রান্না অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে ভেজাল সেমাই নিয়ে ক্রেতাদের মনে একধরনের ভীতিও কাজ করে। নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে সেমাইটাকে বেছে নিয়েছেন। ঘরে বসে নিজেরাই সেমাই বানাচ্ছেন। ঈদের দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিজের বানানো সেমাই খাচ্ছেন। শুধু তা–ই নয়, ব্যবসা করে লাভও করছেন।
'নিজের বানানো ১০০ কেজি লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করেছি। বেশির ভাগই ছিল ঘিয়ে ভাজা সেমাই। করোনাভাইরাসের বিস্তারে দিশেহারা অবস্থা না হলে এবার ঈদে ২০০ থেকে ৩০০ কেজি সেমাই বিক্রির টার্গেট করেছিলাম। তবে দেশের এই পরিস্থিতিতেও যা বিক্রি হয়েছে, তাকে কোনো অবস্থাতেই খারাপ বলা যাবে না।' কথাগুলো বললেন নারী উদ্যোক্তা আইমান ভূঁইয়া। তিনি এবিএইচ ফুডের প্রতিষ্ঠাতা। গত চার বছর ধরে তিনি হাতে বানানো সেমাইসহ অন্যান্য খাবার নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বললেন, 'আমার বানানো লাচ্ছা সেমাই নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করতে পারেননি। সবার কাছ থেকে বেশ প্রশংসা পাই সব সময়। বালুশাই মিষ্টিটাও ক্রেতারা অনেক পছন্দ করেন।'
আইমান ভূঁইয়া নিজস্ব ফেসবুক পেজের মাধ্যমেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তিনি বছরে তেলে ভাজা (৬০০ টাকা কেজি) এবং ঘিয়ে ভাজা (১ হাজার ২০০ টাকা কেজি) সেমাই বানান। আর সেমাই বানানোর কাজটা করেন রাজধানীতে নিজের বাসায়। কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, 'আমি ব্যবসার শুরুতেই ট্রেড লাইসেন্স করেছি। এবার ইচ্ছা ছিল বিএসটিআইএর সনদ নিয়ে ব্র্যান্ডিং করার। দুজন কর্মচারীও রাখতে চেয়েছিলাম। তবে করোনার কারণে ব্যবসার পরিধি ততটা বাড়ানো সম্ভব হয়নি।'
আইমান ভূঁইয়া হোমিওপ্যাথি নিয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। আগে একটি চাকরি করতেন। তবে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। বললেন, 'বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। বাবা অফিস থেকে ফিরেই বাসার সামনে একটি দোকান চালাতেন। ভ্যানগাড়ি করে দোকানে কেক, বিস্কিট দিয়ে যেতেন যিনি, তাঁকে অনুরোধ করে বেকিং পাউডার নিয়ে বাড়িতে কেক বানাতাম। বেকিংটা নেশা ছিল।'
আইমান ভূঁইয়ার একমাত্র ছেলের বয়স এখনো পাঁচ হয়নি। সেমাই বানানো শুরু করার পেছনে ছেলের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে বললেন, 'পা দিয়ে সেমাই বানানো হয়, নোংরা পরিবেশে সেমাই বানানো হয়। এ ধরনের খবরে সেমাই খাওয়াই বাদ দিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম ছেলেকেও ভেজাল খাবার খাওয়াব না। তবে ছেলের বয়স যখন ৮ থেকে ৯ মাস, তখন শ্বশুরবাড়িতে একদিন দেখি ছেলেকে কেউ একজন সেমাই খাওয়াচ্ছেন এবং ছেলেও খুব আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। সেদিনই ঠিক করি, নিজেই সেমাই বানাব। সেমাই বানানোর ছবি ফেসবুকে দিলে অনেকেই অবাক হন যে আমি বাড়িতে বসেই সেমাই বানিয়েছি। অনেকে বেশ উৎসাহ দিতে থাকেন। ব্যবসার প্রথম বছরেই ৩০ কেজি সেমাই বিক্রি করেছিলাম। এখন সেমাই নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করি, কী করলে আরেকটু ভালো হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে বানাই।'
আরেক নারী উদ্যোক্তা আরাজ হোমলি ফুডের প্রতিষ্ঠাতা সুমি আফরোজ। চাকরি ছেড়ে তিনি ২০১৬ সাল থেকে হাতে বানানো বিভিন্ন খাবার নিয়ে ব্যবসা করলেও এবারই প্রথম সেমাই বানিয়েছেন। তিনিও প্রথম শখ করেই বাসায় সেমাই বানিয়েছিলেন, তা খেয়ে সবাই প্রশংসা করেন। ফেসবুকে সেমাইয়ের ছবি দিলে ভালো সাড়া পান। সুমি আফরোজ জানান, করোনাকালের এবারের ঈদে রাজধানীতে ৪৫ কেজি (৯৫০ টাকা কেজি) লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করেছেন। আরও ১০ থেকে ১২ কেজির জন্য অর্ডার ছিল, কিন্তু বাচ্চা, সংসার সামলে সব বানানো শেষ করতে পারেননি। জানান, করোনাভাইরাস বিস্তারের শুরুতে ডেলিভারি সার্ভিসের সহায়তায় পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতেন। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে স্বামীকেও প্রতিদিন অফিস যেতে হচ্ছে না বলে ঈদের আগ পর্যন্ত স্বামী তাঁর মোটরবাইকে করে পণ্য পৌঁছে দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের নারী উদ্যোক্তা নাহার রুমা তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, হোমমেড লাচ্ছা সেমাই। বাজারের পায়ে ডলা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ডালডা আর খোলা ময়দায় বানানো সেমাই থেকে যাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং যাঁরা হোমমেড খাবার পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য আমার এই লাচ্ছা সেমাই। প্যাকেট ময়দা, মাখন এবং ব্র্যান্ডের তেল দিয়ে নিজ হাতে বানানো লাচ্ছা সেমাই।'
আইমান ভূঁইয়া, সুমি আফরোজ এবং নাহার রুমা যুক্ত হয়েছেন দেশীয় পণ্য নিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করা উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই–কমার্স বা 'উই'–এর সঙ্গে। এ প্ল্যাটফর্মের ৮২ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। বর্তমানে এ গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজার।
উইয়ের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, 'আমি নিজেও বাজারে বিক্রি করা সেমাই ভয়ে খাওয়া বাদ দিয়েছিলাম। তবে উই গ্রুপের অনেক উদ্যোক্তা এখন ঘরে বসে নিজের হাতে সেমাই বানাচ্ছেন। নারী উদ্যোক্তা আইমান ভূঁইয়া সেমাই বানানোর ভিডিও গ্রুপে দিয়েছিলেন। তা দেখে এবং অতুলনীয় স্বাদে আবার সেমাই খাওয়া শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত মূলত আইমান ভূঁইয়ার বানানো সেমাই খাচ্ছি। তবে সেমাই বানিয়ে ব্যবসা করা যায়, তা নারী উদ্যোক্তারা প্রমাণ করেছেন। আর উই গ্রুপে পণ্য ভালো ও মানসম্মত হলে তখনই রিভিউ দেওয়া হয়, এর আগে নয়।'