ভ্রমণ
হেলসিঙ্কিতে একবেলা
by অংকন ঘোষ দস্তিদারজাহাজ তখনো হেলসিঙ্কির ঘাটে ভেড়েনি। তবে ফিনল্যান্ডের রাজধানীর অনিন্দ্যসুন্দর আবির্ভাব ক্রমশই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। জাহাজের ছাদে প্রচণ্ড বাতাস, গালফ অব ফিনল্যান্ডের ওপর দিয়ে বয়ে আসা শীতল হাওয়ার তোড়ে চোখ বুজে আসছিল যেন। জোর করে চোখ খোলা রেখে চারদিকের সৌন্দর্য আহরণ করতে লাগলাম। নিজেকে বলছিলাম, ‘তাহলে অংকন, তোমার সাত ঘণ্টার অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে!’ সাত ঘণ্টার অভিযান কেন? কারণ ওই দিন বিকেলবেলায় এই জাহাজে করেই যে আমাকে ফিরতে হবে স্টকহোমে। মাঝে সময় কেবল সাত ঘণ্টা!
সময়টা ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। উইকিম্যানিয়া সম্মেলনে অংশ নিতে বেশ আগেভাগেই পৌঁছেছিলাম সুইডেনের স্টকহোমে। ইচ্ছা ছিল এই সুযোগে প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ড ঘুরে আসা। খুব কাছের এক আঙ্কেল তাঁর ভাতিজার শখ পূরণ করতে আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। যার ফলে ১৩ আগস্ট সকাল ১০টায় ভাইকিং লাইন প্রমোদতরিতে করে প্রায় ১৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষে বঙ্গদেশের এই তরুণ পা রাখল হেলসিঙ্কি শহরে।
কোনো নতুন স্থান ভ্রমণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় আমার মতে হেঁটে ঘুরে দেখা। এই আদর্শে বিশ্বাসী আমি আগেভাগেই গুগল অফলাইন ম্যাপ ডাউনলোড করে রেখেছিলাম। তালিকা করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানেরও। হেলসিঙ্কি শহরের যাবতীয় উল্লেখযোগ্য স্থান কাছাকাছিই, অতএব পদযুগলকে ভরসা করে পাড়ি জমাব নিশ্চিন্তে!
ইউরোপকে আমার বড্ড বেশি ভাগ্যবান বলে মনে হয়। হেলসিঙ্কির রাস্তায় পা রেখে সেই চিন্তা আবারও ফিরে এল। সৌন্দর্যের ভূষণে আগাগোড়া সজ্জিত একেকটি শহর, একেকটি দেশ, অথচ প্রতিটাই কত কাছাকাছি! নেই সীমান্তের চোখরাঙানি; অন্তত আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে যে ধরনের কড়াকড়িতে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না। সীমান্ত কেবল এখানে আন্তর্জাতিক মাপকাঠি, তা ছাড়া এর আলাদা কোনো মাহাত্ম্য নেই।
গালফ অব ফিনল্যান্ডের তীরে অবস্থিত নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম জনবহুল শহর এই হেলসিঙ্কি। ২০১১ সালে বিশ্বের বসবাসযোগ্য নগরের তালিকায় এর অবস্থান ছিল শীর্ষে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সবচেয়ে উত্তরের এই রাজধানীর ইতিহাসের প্রমাণ পাওয়া যায় সুদূর লৌহযুগ থেকে। এ সবকিছু ভেবে যে ভীষণ রোমাঞ্চিত লাগছিল, তা বলা বাহুল্য!
জাহাজ যেখানে ভেড়ে, তার খুব কাছেই হেলসিঙ্কি সেন্টার। এর আশপাশেই অধিকাংশ জনপ্রিয়তম পর্যটন স্থান। আমি দেরি না করে প্রথমেই চলে গেলাম উসপেনস্কি ক্যাথেড্রালে। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ক্যাথেড্রালটা পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত। তাই এখানে দাঁড়িয়ে শহরের অনেকটা দেখা যায়। এখানেই কিছুক্ষণ আবহাওয়া উপভোগ করলাম, বেশ লাগছিল।
এখান থেকে চললাম সিনেট স্কয়ারের দিকে, যেখানে রয়েছে হেলসিঙ্কির প্রতীক হিসেবে পরিচিত হেলসিঙ্কি ক্যাথেড্রাল। ভারি সুন্দর। হেলসিঙ্কিবিষয়ক যেকোনো জায়গায় এই ক্যাথেড্রালটির ছবি থাকবেই। নিওক্ল্যাসিকাল স্টাইলে ১৮৩০ সালে নির্মিত এই ক্যাথেড্রাল দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করেন এখানে। ধর্মীয় উপাসনার জন্যও অনেকেই আসে, তবে মূল ভিড়টা হয় পর্যটকদের জন্যই। এখানেই কিছু ছবি তুলে নিলাম। ক্যাথেড্রালের সামনের প্রকাণ্ড চত্বরে কেউ গান পরিবেশন করছে, কেউবা ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ভালো লাগলে পয়সা রেখে যাচ্ছে অনেকেই। একদল পথশিল্পী বিখ্যাত টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোন্সের টাইটেল ট্র্যাক গাইছিলেন অসাধারণভাবে। পথচলা থামিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনে নিলাম তাঁদের গান। ব্যাপারটা ভালো লাগল। সম্মানজনকভাব অর্থ চাইতে হলে সম্ভবত এর কোনো বিকল্প নেই। এখানে হাত পাতে না কেউ, অর্থের প্রয়োজন নিরিবিলিতে কোনো একটা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে যায়, মানুষ এমনিতেই টাকাপয়সা দিয়ে দেয়। তারা ভিক্ষা করছে না, আয় করে নিচ্ছে সসম্মানে।
ক্যাথেড্রাল দেখা শেষ হলে তালিকাটা আবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এবার গন্তব্য জাদুঘর। জাদুঘর না ঘুরলে কি কোনো শহর ঘোরা শেষ হয়? অতএব একে একে দেখে নিলাম হেলসিঙ্কির সবচেয়ে পুরোনো কাঠের বাড়ি বার্ঘারস হাউস মিউজিয়াম আর হেলসিঙ্কি সিটি মিউজিয়াম। একনজরে হেলসিঙ্কি থেকে শুরু করে গোটা ফিনল্যান্ডের ইতিহাস চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জানলাম, সুইডেনের রাজা প্রথম গুস্তাভই ১৫৫০ সালে এই নগরের গোড়াপত্তন করেন। হেলসিঙ্কির কাছেই স্টকহোম, এস্তোনিয়ার তালিন এবং রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ; ভৌগোলিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকায় এই শহর নিয়ে টানাহেঁচড়া কম হয়নি!
ইতিহাসের পাতা থেকে ফিরে হালকা নাশতা করে নিলাম। এত হাঁটাহাঁটি কি কম পরিশ্রমের ব্যাপার! তবে হাঁপিয়ে গেলে চলবে না, এখনো যে বহু পথ বাকি! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো অঞ্চলে পায়ে হেঁটে ঘুরলেও চক্ষের আরাম হয়।’ স্টকহোম আর এখন হেলসিঙ্কি—এই শহরগুলোকে আমার ঠিক সে রকমই মনে হয়। ইউরোপের বেশির ভাগ শহরের ক্ষেত্রেই বোধ হয় এই কথা খাটে। হেঁটেই চলছি, অথচ ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও আমাকে গ্রাস করেনি। এখানের আবহাওয়া, স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শনই বোধ হয় চাঞ্চল্য বজায় রেখে চলছে। তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রির মতো, অথচ এত হাঁটাহাঁটির ফলে একটুও ঠান্ডা লাগছিল না।
অতএব নব উদ্যমে উঠে দাঁড়ালাম, পা বাড়ালাম হেলসিঙ্কি সেন্ট্রাল স্টেশনের দিকে। বিশালাকার সে স্টেশন দেখে রীতিমতো চোখ কপালে উঠল আমার। শুনেছিলাম, ২০১৩ সালে বিবিসি এই স্টেশনকে বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক স্টেশন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। স্টেশনটি ফিনল্যান্ডের সব গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে যুক্ত। স্টেশনের একদিকে বড়সড় চত্বর, সেখানে নানা ধরনের ভাস্কর্য। ইতিহাসকে এরা সযত্নে লালন করে। এখানে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে গেলাম সেন্ট জনস চার্চে। ঊনবিংশ শতকের এক অনন্য নিদর্শন। এরা পর্যটনস্থানগুলোতে তো বটেই, রাস্তায় রাস্তায়ও বিভিন্ন আকারের পার্ক বানিয়ে রেখেছে। চাইলেই সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা যায়।
একে একে তালিকার সব দেখা তো হলো, কিন্তু ওদিকে মূল একটা কাজই যে করা হলো না! চেখে দেখা হলো না ফিনিশ খাবার! উপসাগরের তীরে অবস্থিত এই শহর, আর আমি কি না সামুদ্রিক খাবার না খেয়েই ফেরত যাব! সেটা হয় নাকি! ফিনিশ এক বন্ধুর কাছ থেকে জেনে নিলাম ভেন্ডেস মাছের কথা, অতি সুস্বাদু হিসেবে যার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। তো আর দেরি না করে চলে গেলাম মার্কেট স্কয়ারে, পথে অবশ্য হেলসিঙ্কি সিটি হলটাও দেখে নিলাম।
মার্কেট স্কয়ার গালফ অব ফিনল্যান্ডের একদম তীরে অবস্থিত। মূলত খাবার, স্যুভেনির আর টুকটাক জিনিসপত্রের পসরা সাজানো। চারদিকে দেশি-বিদেশি হাজারো মানুষ, মূলত পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্যই এই মার্কেট। আমি একটা দোকানে ঢুকে চটপট ভেন্ডেস মাছের প্যাকেজ অর্ডার করে নিলাম। ভীষণ সুস্বাদু খেতে। সারা দিনের পরিশ্রমের পর এর স্বাদ যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। এরপর খানিকক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে মৃদু রোদে উপসাগরে সিন্ধুসারস বা সিগালের উড্ডয়ন উপভোগ করতে লাগলাম। স্বচ্ছ পানিতে সূর্যালোকের অপরূপ প্রভা প্রতিফলিত হচ্ছে, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিগালের স্বাধীন ওড়াওড়ি—মনে বেশ স্নিগ্ধ দাগ কেটে গেল। এখানে কেউ প্রাণীর গায়ে হাত দেওয়ার কথা চিন্তাও করে না, ওরা এ কারণে বেশ নির্ভীক। মানুষের খুব কাছে চলে আসে।
ঘড়ির কাঁটায় তখন চারটা। সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি ধীর লয়ে পা বাড়ালাম ফিরতি পথে। জাহাজ ছাড়ল বিকেল সোয়া পাঁচটায়। এ সময়টাতে নর্ডিক দেশগুলোতে রাত নামে আটটারও পরে। অতএব তখনো উজ্জ্বল সূর্যালোক, অথচ ঘড়ি দেখলে তা মোটেই বিশ্বাস হয় না।
আমি আরও দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথের দিকে। দৃষ্টিসীমায় চতুর্দিকে তখন অতল জলরাশি আর ছোট ছোট দ্বীপ। মাটির সংস্পর্শ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বহুক্ষণ হলো, হেলসিঙ্কিও দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। আমি অবশ্য তখনো দিব্যি সব দেখতে পাচ্ছিলাম, চোখে রেশ লেগে রয়েছে যে!
কী জানি, হয়তো আবারও দেখা হবে!