স্মরণ
ওসমানী চির ভাস্বর
by আহবাব চৌধুরীমহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে লড়ে যাওয়া এক সাহসী সেনাপতির নাম জেনারেল এম এ জি ওসমানী। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাহসী ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জেনারেল এম এ জি ওসমানী চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন।
জেনারেল ওসমানীর মতো কিছু চৌকস ও অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তার কারণেই মূলত ১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম। ওসমানীর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন যেমন মেধাবী, তেমনি সৎ, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক ও নীতির প্রশ্নে আপসহীন। ১৬ ফেব্রুয়ারি সাহসী এই বীরের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতির এই কৃতি সন্তান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেও তাঁর চিরঞ্জীব স্মৃতি জাতির মানসপটে অম্লান থাকবে অনন্তকাল।
জেনারেল ওসমানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে। তাঁর বাবা খান বাহাদুর মফিজুল ইসলাম সে সময় সুনামগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। ওসমানীর বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত এক সরকারি কর্মকর্তা। তিনি পরে আসামের জেলা প্রশাসক হন। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ওসমানীর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে একেক সময় একেক জায়গায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস সিলেট জেলার বালাগঞ্জ (বর্তমান ওসমানীনগর) উপজেলার দয়ামির গ্রামে। ১৯৩৪ সালে তিনি সিলেট সরকারি পাইলট স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকে ১৯৩৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯৩৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালেই তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৪১ সালে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালে মেজর পদে পদোন্নতি পান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৫৬ সালে কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। এ সময় তিনি তাঁর মেধা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ববলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ওসমানী দক্ষতার সঙ্গে মিলিটারি অপারেশনের উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ওসমানী কর্নেল থাকাবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ওসমানীর রাজনৈতিক জীবন
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে ওসমানীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ আসন থেকে নির্বাচন করে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু এই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করলে শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ সময় ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া সব সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের সংগঠিত করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। এ সময় কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের এক ঘোষণায় কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জেনারেল পদের মর্যাদা দেয়। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে আবার রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব গঠিত মন্ত্রিসভায় তিনি জ্বালানি, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিশ্বনাথ আসন থেকে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে ওসমানীর মতদ্বৈধতা দেখা দিলে ১৯৭৪ সালের মে মাসে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে জেনারেল এম এ জি ওসমানী জাতীয় সংসদের সদস্য পদ এবং একই সঙ্গে দলীয় সদস্য পদ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি জাতীয় জনতা পার্টি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালে দেশে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
জেনারেল ওসমানী ছিলেন আমাদের অহংকার। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে বঙ্গবীর পদকে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত হয়েছিল। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানকে আজ খাটো করে দেখা হয়। সরকারের সঙ্গে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ক্ষমতার রাজনীতি ত্যাগ করেছেন, তবুও নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। সেদিনের সেই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য তিনি চীরকাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ইংল্যান্ডের একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অমিত সাহসী এ বীর। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হজরত শাহজালালের (রা) মাজারে সমাহিত করা হয়। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে, তত দিন জেনারেল ওসমানী বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।