বাংলাদেশের নির্বাচন: সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব

by
https://cdn.banglatribune.com/contents/cache/images/350x0x1/uploads/media/2020/01/09/54f59dc0ae4472378b47b313b8529bb9-5e170ce672255.jpg
আমীন আল রশীদ

বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় মূলত প্রতিবারই ‘সংখ্যালঘিষ্ঠের’ সরকার গঠিত হয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও যারা বিজয়ী হন, তাদের পক্ষেও অধিকাংশ মানুষের সমর্থন থাকে না—যার সবশেষ উদাহরণ ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মেয়র হয়েছেন মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে। আর  দক্ষিণে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়র হয়েছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, উত্তর সিটিতে ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। তার মানে উত্তরে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং দক্ষিণে ভোট দেননি প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি। আবার যে সামান্য সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছে, তাদেরও সবাই  আতিক ও তাপসকে ভোট দেয়নি।
যেহেতু বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে তার কোনও সীমারেখা নেই, সেহেতু ১০ শতাংশ ভোটারের ম্যান্ডেট নিয়েও যে কেউ জনপ্রতিনিধি হতে পারেন। একইসঙ্গে এই নির্বাচনকে সাংবিধানিক বা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ নেই। সুতরাং ঢাকা উত্তর সিটিতে আতিকুল ইসলামকে মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন মানে বাকি ৮৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটিতে ফজলে নূর তাপস মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন মানে বাকি ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন—এমনটি বলার সুযোগ নেই। কারণ ভোট দেওয়া যেমন নাগরিক অধিকার, তেমনি কেউ যদি ভোট না দেন বা দিতে না চান, সেটিও তার অধিকার।

নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন করে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল যাতে ভোটাররা কোনও প্রার্থীকে পছন্দ না হলে ‘না’ ভোট দিতে পারেন। কিন্তু ওই নির্বাচনের পরে গঠিত সরকার বিধানটি বাতিল করে। অর্থাৎ এখন আর ‘না’ ভোটের বিধান নেই। ‘না’ ভোটের বিধান থাকলে বোঝা যেতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে কত শতাংশের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। এই সংখ্যাটি বাড়তে থাকলে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলগুলো অধিকতর সতর্ক হতো। কিন্তু যেহেতু জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার—উভয় ক্ষেত্রে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিশাল বাণিজ্য হয় এবং সেখানে পরিবারতন্ত্রসহ নানারকম হিসাব-নিকাশ থাকে। ফলে ‘না’ ভোটের বিধান থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়তো—সেটি বিবেচনায় রেখেই সম্ভবত বিধানটি বাতিল করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো—মানুষ কেন ভোটের ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে? নানাজন এর নানারকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, মানুষ ‘সুখে-শান্তিতে’ আছে বলে ভোট দিতে যায়নি। কতজন এই তত্ত্ব বিশ্বাস করেন, তা গবেষণার বিষয়। তবে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, মানুষ আগেভাগেই জানে যে ভোটের ফল কী হবে। অর্থাৎ যে খেলার ফল নির্ধারিত, সেই খেলা দেখার জন্য মানুষ কষ্ট করে মাঠে যাবে না—এটিই স্বাভাবিক। তবে এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় সেটি নয়। আমরা বরং দেখতে চাই, কীভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠের সরকার গঠিত হয় বা কীভাবে অধিকাংশ মানুষের সমর্থন ছাড়াই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন।

১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪১ দশমিক ২, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৪২ দশমিক ৩৪, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮১, ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে প্রথম যে সংসদ নির্বাচন হয়, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ল্যান্ডস্লাইড বিজয় ছিল স্বাভাবিক। ওই নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ টিতেই জয় পায়। তাদের ভোটপ্রাপ্তির শতকরা হার ছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এর বাইরে মাত্র একটি করে আসন পায় জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। আর স্বতন্ত্র ৫ জন। দেখা যাচ্ছে, জাসদ ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসন পেলেও ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েও কোনও আসন পায়নি ন্যাপ (মোজাফফর)।

দেশের ইতিহাসে তুলনামূলক ভালো নির্বাচন বলা হয় ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনকে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩০ দশমিক  ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপি আসন পায় ১৪০টি, অথচ মাত্র শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ কম ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ৮৮টি। অর্থাৎ ভোটের ব্যবধান এক শতাংশেরও কম। অথচ আসনের ব্যবধান ৫২। ওই নির্বাচনে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ৫টি আসন পেলেও ১ দশমিক ২২ ভাগ পেয়েও একটি আসনও পায়নি জাকের পার্টি। ভোটের শতকরা হারের এই ব্যবধানের কারণ জাকের পার্টি প্রার্থী দিয়েছিল ২৫১টি আসনে। আর বাকশালের প্রার্থী ছিল ৬৮টি আসনে।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির মোট ভোটের শতকরা ব্যবধান ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অথচ আসনের ব্যবধান ৩০। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন ছিল ১৪৬ আর বিএনপির ১১৬।

২০০১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অথচ বিএনপি আসন পায় ১৯৩টি, আর আওয়ামী লীগ ৬২টি। ভোটের শতকরা হার বিবেচনায় আসন বণ্টন করা হলে এ দুটি দলের আসন সংখ্যা হতো কাছাকাছি। অর্থাৎ উনিশ-বিশ। কিন্তু বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় একটি দল আরেকটি দলের চেয়ে পপুলার ভোটে সামান্য পিছিয়ে থাকলেও মোট আসন সংখ্যায় পিছিয়ে অনেক।

এই পদ্ধতির সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ২৩০টি, অথচ ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপির আসন শুধু ৩০টি। ভোটের সংখ্যানুপাতিক বিচারে আসন বণ্টন হলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির আরও বেশি আসন পাওয়ার কথা।

আমাদের দেশে এখন যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, সেটিকে বলা হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি)। অর্থাৎ যিনি বেশি ভোট পাবেন (তিনি যদি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোটও বেশি পান) তিনিই জয়ী এবং বাকিরা সবাই পরাজিত।

এই পদ্ধতির নির্বাচনের আরেকটা বড় দুর্বলতা সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া। যখন সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন এবং বাকিরা সবাই গৌন।তখন বিজয়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের কায়দা-কানুন, অনিয়ম ও অরাজকতা চলে। যখন ব্যক্তির জয়ই এখানে মুখ্য, তখন সমাজের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। এই পদ্ধতিতে এমন সুযোগও আছে যে, কোনও দলের তাদের সামগ্রিক ভোটের সংখ্যা বা পপুলার ভোট পরাজিত  দলের চেয়ে কম হলেও বেশি আসনে জয়ী হওয়ায় তারা সরকার গঠন করতে পারে।

মূলত এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (Proportional Representation) পদ্ধতি চালু আছে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি নয়, বরং দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারা দেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায়, আনুপাতিক হারে সংসদে সে সেই পরিমাণ আসন পায়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই মূল্যায়ন করা হয় এবং যে দল কম ভোট পায়, সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। আমাদের সংসদে এখন সংরক্ষিত নারী আসনের বণ্টনও এই আনুপাতিক হারে হয়। অর্থাৎ মূল নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো যে আসন পায়, সেই অনুপাতে ৫০ জন সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচিত হন। অথচ মূল নির্বাচন হয় অন্য পদ্ধতিতে।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রতিটি দলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে দেয় এবং তালিকাটি গোপন রাখা হয়। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই আলোকে ওই তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি পায়। যেমন, বিদ্যমান ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচনে যদি কোনও দল ১ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে আনুপাতিক হারে তারা সংসদে ৩টি আসন পাবে। এরপর প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠনের জন্য মোট প্রাপ্ত ভোটের ৫১ শতাংশ যে দল পাবে তারা সরকার গঠন করবে। কোনও দল এককভাবে ৫১ শতাংশ না পেলে একাধিক দল মিলে জোট গঠন করেও সরকার গঠন করতে পারে। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট দেন দলকে, কোনও ব্যক্তিকে নয়। কারণ আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে গেলে সংসদে ছোট বড় মাঝারি সব দলেরই সদস্য থাকবে। এতে অনেক শক্তিমান প্রার্থী বাদ পড়বেন।

বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে ভোট হওয়ায় দলগুলো প্রতিটি আসনে এমন সব প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় যাদের নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি; সেটি যেভাবেই হোক। এ কারণে বেছে বেছে শক্তিশালী প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলে এবং কমিউনিটিতে কার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, জনগণের সঙ্গে কার যোগাযোগ বেশি, কার শিক্ষাদিক্ষা ও সংস্কৃতি কেমন—এসব বিবেচনায় আসে না। বরং যিনি মেরে-কেটে কিংবা যে করেই হোক নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে আসতে পারবেন বলে দলের হাইকমান্ড মনে করে—তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়।

যেহেতু এই পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে এক ভোট বেশি পেলেও তিনি জয়ী—সুতরাং এই একটি ভোট বেশি পাওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এবং নানারকম অপশক্তি প্রয়োগ করেন। মূলত এ কারণেই দেশের রাজনীতিও টু পার্টি পলিটিক্সে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভাবনায় শুধুই নৌকা আর ধানের শীষ। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে আসবে। ব্যক্তির বদলে মানুষ যখন দলকে ভোট দেবে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে হানাহানি বন্ধ হবে। যে দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে, তারা যেমন সংসদে থাকবে, তেমনি ১০ শতাংশ ভোট পেলে সেই দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অর্থাৎ সংসদ হয়ে উঠবে সর্বদলীয়। কিন্তু বর্তমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় আমাদের সংসদ মূলত একদলীয় এবং কখনো-সখনো শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেও অধিকাংশ দলই থাকে সংসদের বাইরে। অথচ তাদেরও কমবেশি ভোট আছে। সুতরাং যে অল্প সংখ্যক মানুষও ওই দলগুলোকে ভোট দিয়েছে, সেই ভোটারদের অভিমতের কোনও মূল্যই বিদ্যমান ব্যবস্থায় নেই।

আমাদের সংসদ যেহেতু এক কক্ষবিশিষ্ট, ফলে এখানে প্রত্যক্ষ ভোটের বাইরে গিয়ে সমাজের শিক্ষিত ও প্রান্তিক অংশ থেকে কাউকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে আনারও সুযোগ নেই। অথচ প্রতিবেশী ভারত এমনকি নেপালেও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের ভাবনা থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পাশাপাশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধানও বন্ধ করা জরুরি। সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী তিন শত সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’ প্রত্যক্ষ নির্বাচন মানে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা আবশ্যক। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা আছে, একাধিক প্রার্থী না থাকলে একক প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আইনের ব্যাখ্যা যাই থাক, এটি কোনও অর্থেই গণতান্ত্রিক নয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুস সালামের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সম্পর্কিত আরপিওর ১৯ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না মর্মে একটি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৪ সালের ১৯ জুন আদালত রিটটি খারিজ করে দেন। আদালত বলেন, সংবিধানের সঙ্গে আরপিওর এই ধারাটি সাংঘর্ষিক নয়।

তবে নির্বাচনি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টনের ব্যবস্থা চালু করা গেলে এইসব বিতর্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দূর হবে। এই ব্যবস্থা চালু হলে ভোটের সময় নির্বাচনকালীন সরকার, অন্তর্বর্তী না কি তত্ত্বাবধায়ক—সেসব নিয়েও বিতর্কের অবসান হবে বলে আশা করা যায়।

এটি জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এরকম Proportional Representation বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সুযোগ নেই। তবে এখানেও রিকলের ব্যবস্থা রাখা উচিত। অর্থাৎ নাগরিকরা যদি মনে করেন, তাদের জনপ্রতিনিধি প্রতিশ্রুতি পূরণে বা সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাহলে যেকোনো সময় তাকে সরিয়ে দেওয়ার সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকা উচিত। এখনও সরকার চাইলে যেকোনও সময় যে কাউকে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এই সরিয়ে দেওয়াটি হয় মূলত রাজনৈতিক কারণে। নাগরিকের স্বার্থে কখনও কোনও জনপ্রতিনিধিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন নজির নেই।

তবে এইসব তর্কের বাইরে গিয়ে মানুষ কেন ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং সেখানে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের কী ব্যর্থতা রয়েছে, এ মুহূর্তে সেটি খুঁজে বের করা জরুরি। সেইসঙ্গে এ থেকে উত্তরণের পথও রাজনীতিবিদদেরই বের করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে দেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।