হারিয়ে যাওয়ার ৩৪ বছর পর মায়ের বুকে ফিরল মেয়ে
by প্রতিনিধি, নাটোরসাত বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার ৩৪ বছর পর মা-বাবার পরিবারে ফিরে এসেছেন মুন্নি খাতুন। শুধু একাই ফেরেননি, সঙ্গে এসেছে স্বামী-সন্তান। এতিম মুন্নি আবার ফিরে পেলেন মা-বাবার পরিচয়। তবে বাবা বেঁচে থাকলে মুন্নির আনন্দটা হয়তো ১৬ আনাই পূর্ণ হতো। তাঁকে ফিরে পেয়ে পরিবারে এখন আনন্দের বন্যা।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাকা ইউনিয়নের সলইপাড়া গ্রামের মুনছের আলী ও নাজমা বেগমের মেয়ে। মুনছের আলী সাত বছর আগে মারা গেছেন। মুন্নিকে দেখতে আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও গ্রামের মানুষের ভিড় জমে। নাটোরের লালপুর উপজেলায় নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন মুন্নি।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে সাত বছর বয়সে মুন্নি পাশের লালপুর উপজেলার মিলকিপাড়া গ্রামে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। গত মাসের মাঝামাঝি সলইপাড়া গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে লালপুরের গোপালপুরে মুন্নির পরিচয় হয়। গল্পে গল্পে বলেন তিনি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক নারী। মুন্নি নিজের নাম ছাড়া বাবা-মা ও গ্রামের নাম কিছুই মনে করতে পারেননি। ওই ব্যক্তির মাধ্যমে এ খবর চলে আসে মুন্নির মায়ের কাছে। বয়সের ভারে মা গোপালপুরে যেতে না পারায় মুন্নিকে বাড়িতে দাওয়াত করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার মুন্নি তাঁর স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সলইপাড়া গ্রামে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তখন তাঁর চোখের পাতার নিচের তিল, হাতে পোড়া দাগ দেখে মাসহ আত্মীয়-স্বজনরা সবাই নিশ্চিত হন এই নারীই হারিয়ে যাওয়া মেয়ে মুন্নি খাতুন। মুহূর্তে তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। আনন্দের অশ্রুতে সবাই সিক্ত তখন। ফিরে পাওয়া মুন্নিকে দেখতে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও গ্রামের মানুষের ভিড় জমে। মুন্নি, তাঁর স্বামী ও দুই সন্তানকে মায়ের সঙ্গে বসিয়ে সবাই মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাড়িতে চলছে শীতের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম।
মুন্নি খাতুনের স্বামী আমিরুল ইসলাম জানান, লালপুরে উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ (সাধু চেয়ারম্যান) মুন্নিকে লালন পালন করেন। তিনি ওই চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় কাবিননামায় পালক পিতা হিসাবে চেয়ারম্যানের নামই লেখা হয়েছিল। বর্তমানে তাঁদের দুই ছেলে সাজেদুল ইসলাম ও রাজিবুল ইসলাম। তিনি আরও জানান,চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ মারা যাওয়ার আগে মুন্নিকে কুড়ে পাওয়ার ঘটনা বলে গেছেন। ১৯৮৬ সালে গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে বসে কাঁদছিল মুন্নি। নাম ঠিকানা বলতে না পারায় তাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান এবং তিনিই তাকে লালন-পালন করেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন মুন্নি।
মুন্নি খাতুন জানান, তিনি আছিয়া বেগম নামে বড় হয়েছেন। মা-বাবার চেহারা ছাড়া ছোট বেলার কোনো কিছুই তাঁর মনে নাই। তবে মাকে প্রথম দেখাতেই তিনি চিনতে পেরেছেন। যদিও মা ও স্বজনদের পক্ষে তাঁকে চিনতে কিছুটা কষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর স্বামীর সংসারে ‘কুড়ে পাওয়া মেয়ে’ হিসাবে পরিচয় দিতে আমার খুব খারাপ লাগত। মাকে ফিরে পেয়ে সেই কষ্ট দূর হয়েছে। এতে আমার স্বামী ও সন্তানরাও খুব খুশি হয়েছে। সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ।’
মা নাজমা বেগম বলেন, ‘মিয়াক (কন্যাকে) খুঁজি পাবো তা ভাবতেও পারিনি। মিয়া আমার কত্তবড় হয়ছে। যকন হারায় গিছিলো তকন হাফপ্যান্ট পরি থাকতো। আর একন শাড়ি পরি আইছে। ওর কাটা দাগ আর তিল দেকতে না পারলে চিনতেই পারতাম না। মরার আগে মিয়াক পাইয়া জানডা শান্তি লাগছে। ওকে যে মানুষ করছে,বিয়ে করছে তাদের জন্যও দোয়া করচি।’