মানবিক আমেরিকাই কাঙ্ক্ষিত

অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য দরজা বন্ধ

পৃথিবী সেরা হতে হলে শুধু শৌর্য-বীর্যে সেরা হলেই চলে না। সঙ্গে থাকা চাই উচ্চ মানবিক মূল্যবোধ। এ ক্ষেত্রে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র শিন্ডলারস লিস্টের একটি দৃশ্যের কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
জার্মান নাৎসি পার্টির সদস্য অস্কার শিন্ডলার অসহায় ইহুদিদের রক্ষায় একটি গল্প বলেন, এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে। নিচে কাজ করতে থাকা বন্দীদের দিকে বন্দুক তাক করে বসে থাকা ওই কর্মকর্তাকে বলা গল্পটির মূল ভাষ্য ছিল, হত্যা যে কেউ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে একজন সেনা ও সম্রাটের মধ্যে তেমন কোনো তফাত নেই। দুজনই চাইলে আটক ব্যক্তিকে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু একজন সম্রাট সাধারণ একজন সেনা থেকে আলাদা হন, তাঁর ক্ষমার গুণ দ্বারা। ক্ষমা করার গুণ ও ক্ষমতা সবার থাকে না। শিন্ডলারের বলা এ গল্পের ফল হয়েছিল জাদুর মতো। হওয়ারই কথা; কারণ, কথাটি সত্য।
শিন্ডলার্স লিস্ট চলচ্চিত্রের কথাটি সামনে এল এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার কারণে। ওই চলচ্চিত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কে তুলে ধরা হয়েছিল। সেই মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মানি নিজের সামরিক শক্তি দিয়ে বিশ্বজয় করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল এক ‘মহান জার্মানি’ বিশ্ব শাসন করুক। কিন্তু মহত্ত্ব ছাড়া তো মহান হওয়া যায় না। তাই জার্মানিও জয়ী হয়নি। সেই মহাযুদ্ধের জয়ী পক্ষে বরং অবস্থান নিয়েছিল আমেরিকা। এ কথা এখন বিশ্বের সবাই জানে এবং মানে। সে সময় সারা বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে নিজের দরজা খুলে দিয়েছিল আমেরিকা। ব্রিটেনের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ যে করেনি, তা নয়। কিন্তু তার মানবিক রূপটি শক্তির দম্ভের নিচে চাপা পড়ে যায়নি। আর এটিই তাকে মহান করে তুলেছিল।
আজকের অভিবাসীদের দেশ আমেরিকার বিশ্বমোড়ল হওয়ার ভিতটি কিন্তু সে সময়েই বিকশিত হয়েছিল। সেই শক্তি ও মহত্ত্বের যুগল উপস্থিতির সময়েই। অথচ এখনকার প্রশাসন এই ‘গ্রেট আমেরিকা’ ফিরিয়ে আনার কথা বলে ভুলে বসে আছে সত্যিকারের মহৎ হওয়ার কায়দাকানুন। তারা শুধু শক্তি দেখাচ্ছে, তারা শুধু কঠোর হচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে কৃপণ কখনো মহারাজ হয় না।
এই কৃপণতার সর্বশেষ নিদর্শন হিসেবে সামনে এসেছে আরও কঠোর অভিবাসন নীতির প্রসঙ্গ। এবার খড়্গটি পড়ছে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর। বার্থ ট্যুরিজম বন্ধের নাম করে তারা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের আমেরিকা ভ্রমণে ভিসা দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ঠিক একই সময়ে ‘গর্ভপাতবিরোধী’ সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনমিতি ‘ঠিক’ পথে আনতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। কথা হচ্ছে, কোন জনমিতি? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবেই অস্বস্তিতে ফেলবে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ধারণার পৃষ্ঠপোষক বর্তমান প্রশাসনকে। কারণ, আদিবাসী আমেরিকানদের কোণঠাসা করে জনমিতি তো মূলত তারাই বদলে দিয়েছিল। চিফ সিয়াটলের সেই বিখ্যাত চিঠি তো ভোলার নয়।
কোনো অজুহাতেই আদতে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য আমেরিকার দরজা বন্ধ কিংবা নারীদের দীর্ঘ লড়াইয়ে অর্জিত অধিকার হরণ করা যায় না। কোনো মহত্ত্বের গল্প দিয়ে কারও পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যায় না। তেমনটি করা হলে আমেরিকা শুধু বৈশ্বিক পরিসরে খাটোই হবে, যা তার ভবিষ্যৎ প্রভাব বলয় সংকুচিত করবে। তাই আমেরিকার স্বার্থেই আমেরিকাকে মানবিক হতে হবে।