https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2020/01/31/f1fd92c28359f98f8db19970d6a11713-5e34208449b5c.jpg?jadewits_media_id=1505410
চলতি পথে

বেঁচে থাকার সবুজ বাতি

by

আমার শিয়রের পাশে এক টেবিল। সেখানে ওষুধ-পথ্যের সঙ্গে মনিটরিং ডিভাইস, ল্যান্ড ফোন সাইজের। তিন বছর আগে মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে বুকে পেসমেকার বসানোর পর যেদিন বাসায় ফিরব, একটি ছোট্ট বাক্স নিয়ে হাজির হলেন এক ভদ্রলোক। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ডাক্তার বিদায়ী উপদেশ দিতে এসেছেন। আগন্তুক পরিচয় দিলেন, তিনি বোস্টন সায়েন্টিফিকের প্রকৌশলী। যাদের পেসমেকার আমি হৃদয়ে ধারণ করেছি। তিনি বাক্সটি খুলে বের করলেন এক ডিভাইস, প্লাগ ইন করে দেখালেন—মাঝে একটি সবুজ বাতি জ্বলছে। বললেন, আপনার বেডরুমে শিয়রের কাছে এটা প্লাগ ইন করে রাখবেন। ২৪ ঘণ্টা সচল থাকবে। তাহলে আমরা জানতে পারব আপনার পেসমেকারের অবস্থা। সর্বক্ষণ জ্বলবে এই সবুজ বাতি। সেই থেকে এটি আমার শিয়রের পাশে। তিন বছরে মুহূর্তের জন্যও নেভেনি।
কখনো অবসাদে বা আনমনে যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি, বেঁচে আছি কিনা বোঝার জন্য চিমটি কাটতে হয়নি। তাকিয়ে দেখি ডিভাইসের সবুজ বাতিটি জ্বল জ্বল করছে। তার মানে বেঁচে আছি।
অন্ধকার রুমে এ বাতিটিই এখন আমার বাঁচার প্রতীক। কিন্তু পরশু রাতে এক ঘটনায় নিজেকে পুরো হারিয়ে ফেলি। সে ঘটনা বলব আজ। তার আগে অন্য গল্প শোনাতে চাই।
আল জাজিরা শুনছিলাম। খবর পাঠক বলছিলেন, ‘অপেক্ষা করুন, আমাদের হাতে আছে প্রচুর খবর।’ পৃথিবীজুড়ে এখন খবর আর খবর। এত এত ঘটনা! কোনটার চেয়ে কোনটার গুরুত্ব বেশি, কুল পাই না হিসেব কষে।
চীনের করোনাভাইরাস আতঙ্কের মাঝেই এল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা। জেরুসালেমকে রাজধানী করে আরও দখলি জায়গা নিয়ে ইসরায়েল, যার মধ্যে থাকবে জর্ডান ভ্যালি। আরও থাকবে অবৈধ বসতির বৈধতা। আর পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, তাও এখনই নয়। সঙ্গে আছে নানা কঠিন শর্ত।
এর মধ্যে আছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো সামরিক বাহিনী থাকবে না। ফিলিস্তিনিরা বলছে, জেরুসালেমের ব্যাপারে কোনো আপস নয়। এই পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের।
ফিলিস্তিনিদের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন প্রেসিডেন্সির শুরুতেই। তিনি প্রমাণ করেছেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনিই ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সমর্থক। ২৮ জানুয়ারি এর স্বীকৃতি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হোয়াইট হাউসে শান্তি পরিকল্পনা পেশকালে ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, এই অফিসে (হোয়াইট হাউস) ট্রাম্পের মতো এত বড় বন্ধু ইসরায়েল আর কখনো পায়নি।
শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণার আগেই ট্রাম্প আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা ও মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তর করেন। সরে আসেন ‘দুই রাষ্ট্র’ নীতি থেকে। ফিলিস্তিনকে বছরে বছরে যে অর্থ সহায়তা দেওয়া হতো, তা বন্ধ করে দেন। এত কিছুর পর ফিলিস্তিনিরা কী করে তাঁর ওপর ভরসা রাখতে পারে?
ভরসা কিন্তু রেখেছে সৌদি আরব। ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনার প্রশংসা করেছে তারা। তবে নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক। খবরে দেখলাম, ফিলিস্তিনিরা আরব প্রতিবেশীদের নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে।
হতাশ হওয়ার কারণও আছে। সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে এত দিনের গোপন সখ্য এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ হচ্ছে। সম্প্রতি জানা গেল, ইসরায়েলিরা এখন থেকে সৌদি আরব সফর করতে পারবে, এ মর্মে দেশ দুটির মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। জানি না, আরও কত ব্যাপারে না জানি সমঝোতা হয়েছে!
অনেকের প্রশ্ন, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু এই সময়ে শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে কেন? তার উত্তর আসছে সংবাদমাধ্যমে। দুজনের সামনেই কঠিন পরীক্ষা। ট্রাম্পের সামনে অভিশংসন ও নির্বাচন, নেতানিয়াহুর সামনে তাঁর দুর্নীতির বিচার ও নির্বাচন। দুজনই চাইছেন শান্তি পরিকল্পনা দিয়ে তাঁদের ভবিষ্যৎ ভাগ্যকে প্রভাবিত করতে। তা কি তাঁরা পারবেন? দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।
খবরের ভিড়ে ছোট্ট এক খবর—‘আমরা শুধু ডেলিভারি দিয়েছি, রিসিভ করার অভিজ্ঞতা হয়নি কখনো’। ইরানি জেনারেল সোলাইমানির হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালায় ইরান। হামলার পর ট্রাম্প জানান, ক্ষয়ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি, নেই কোনো হতাহত। পরে জানা গেল, ৩৪ জন মার্কিন সেনা হাসপাতালে গেছেন হামলাজনিত মস্তিষ্কের সমস্যা নিয়ে। ট্রাম্প অবশ্য এটাকে হালকা করে দেখাতে চেয়েছেন এ কথা বলে—ওসব মারাত্মক কিছু না, সামান্য মাথা ব্যথা। হামলার পর মার্কিন ঘাঁটিতে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। সৈনিকদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগও পান সাংবাদিক।
ছবিতে দেখা যায়, ধ্বংসযজ্ঞ। সৈনিকেরা বর্ণনা করছিলেন হামলাকালীন বিভীষিকার কথা। কীভাবে তাঁরা বেঁচে গেলেন—সেই কাহিনি।
এক জায়গায় এসে সাংবাদিকের বর্ণনা শুনছিলাম, আমেরিকানরা এত দিন শুধু ডেলিভারি দিয়ে এসেছে। অর্থাৎ বোমা বর্ষণই করে আসছে, রিসিভ করার অভিজ্ঞতা হয়নি। এবার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের ওপর বোমা এসে পড়েছে। এ অভিজ্ঞতা তাদের জন্য নতুন।
এবার ফিরে আসি আমার পেসমেকারের কাহিনিতে। পরশু গভীর রাত। প্রকৃতির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার রুম। দেখি, সবুজ বাতিটিও নেই যা আমার বেঁচে থাকার প্রতীক। অন্ধকার রুমেও দেখা যেত মিটিমিটি জ্বলছে সবুজ বাতি। তাড়াতাড়ি রুমের বাতি জ্বালিয়ে দেখলাম, সত্যিই সবুজ বাতিটা নেভানো। তা হলে আমি কি বেঁচে নেই? গায়ে হাত বুলিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম, হ্যাঁ বেঁচে আছি তো। দিব্যি শ্বাস নিচ্ছি। মনিটরিং ডিভাইসের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করলাম, প্লাগ ইন আছে। বিচ্ছিন্ন নয়। ভয়ে জড়িয়ে গেলাম। বোস্টন সায়েন্টিফিককে কি ফোন করব?
এই ভাবনার মাঝেই দেখি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে প্রথমে কমলা রং ছড়িয়ে জ্বলে উঠল বাতি, তারপরই এল সবুজ বাতি, আমার হৃদয়ের মণি। বেঁচে থাকার আনন্দে আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে যাইনি, সবুজ বাতিটি নিভেছিল কেন?