বার্সেলোনা যেন মাছ বাজারের ক্রেতা
by নিশাত আহমেদদলবদলের বাকি আছে আর মাত্র এক দিন। হন্যে হয়ে স্ট্রাইকার খুঁজছে বার্সেলোনা। কিন্তু পাচ্ছে না কাউকেই!
বাংলাদেশের যে কোনো একটা মাছ বাজারের কথা চিন্তা করুন।
প্রচুর লোকের আনাগোনা দেখতে পাবেন, মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় করা ছা-পোষা বাঙালির সংখ্যাই বেশি। ইলিশ, গলদা চিংড়ি, বোয়াল, আইড়, রুপচাঁদা, পাবদার মতো সুস্বাদু মাছ খেতে ইচ্ছে হলেও কত জনেরই বা সামর্থ্য থাকে সেসব মাছ কেনার? শেষমেশ দেখা যায় পকেটের কথা চিন্তা করে রুই, পুঁটি বা কার্প মাছেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তা যে মাছই কেনা হোক না কেন, দামাদামি করতে তো আর বাধা নেই। ফলে মাছের বাজারে হই-হট্টগোল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ক্রেতারা এসে মাছ দাম করছেন। কখনো হয়তো মাছ পছন্দ হচ্ছে না, আবার কখনো মাছ পছন্দ হলেও দামে মিলছে না। আবার যে মাছটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ, সে মাছটা হয়তো আরেক জন কিনে কাটতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সাধের সঙ্গে সাধ্য ও অন্যান্য পরিস্থিতির মেলবন্ধন হয় সামান্যই।
একই অবস্থা যেন হয়েছে বার্সেলোনার। ‘মাছ কিনতেই হবে’—এই মনোভাব নিয়ে বাজারে যাওয়া মানুষ যেভাবে হন্য হয়ে মাছ খোঁজেন, শীতকালীন দলবদল নামের এই ‘মাছ বাজারে’ বার্সেলোনা তেমনি খুঁজছে স্ট্রাইকার।
গত এক বছর ধরেই লুইস সুয়ারেজের জায়গায় নতুন স্ট্রাইকার আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বার্সেলোনা। পায়নি কাউকেই। এখন আবার সুয়ারেজ পড়েছেন চোটে। আগামী মৌসুমের আগে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে আর মাঠে নামতে দেখা যাবে না ৩৩ বছর বয়সী উরুগুইয়ান স্ট্রাইকারকে। ফলে আরও ঝামেলায় পড়েছে বার্সেলোনা। মূল একাদশে খেলানোর মতো স্ট্রাইকার খুঁজছে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু নিজেদের ‘বি’ দলে যেসব স্ট্রাইকার ছিল, তাদেরও সুযোগ দিতে রাজি নয় ক্লাবটি। কার্লেস পেরেসকে এএস রোমার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়ে গেছে, আরেক তরুণ স্ট্রাইকার আবেল রুইজকে ধারে পাঠানো হয়েছে পর্তুগিজ ক্লাব ব্রাগায়।
আর অন্যদিকে স্ট্রাইকার-খোঁজ চলছেই। এই স্ট্রাইকার খুঁজতে গিয়ে গোটা মাস ধরে বার্সেলোনা যা করছে, তা একই সঙ্গে জন্ম দিয়েছে হাস্যরস ও সমালোচনার।
বার্সেলোনার স্ট্রাইকার খোঁজা শুরু হয় লস অ্যাঞ্জেলেস এফসির মেক্সিকান স্ট্রাইকার ও আর্সেনালের সাবেক তারকা কার্লোস ভেলাকে দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের এমএলএসে গিয়ে আলো ছড়ানো ৩০ বছর বয়সী ভেলাকে গত এক বছর ধরেই স্প্যানিশ ক্লাবটি নজরে রেখেছে বলে শোনা যাচ্ছিল। এমএলএসের আরেক মেক্সিকান খেলোয়াড় জোনাথান দস সান্তোস স্বদেশি ভেলার প্রতি বার্সেলোনার আগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু পরে সে চুক্তিটা হয়নি।
এরপর এলেন লওতারো মার্তিনেজ। ভেলার মতো গত এক বছর ধরে মার্তিনেজও ছিলেন বার্সার নজরে। কিন্তু ইন্টার মিলান সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, তাঁদের এই রত্নটিকে নিতে ‘বাই আউট ক্লজে’র (খেলোয়াড়ের বর্তমান ক্লাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে কিনতে গেলে আগ্রহী ক্লাবকে যে অর্থ পরিশোধ করতেই হবে) পুরো ১১ কোটি ১০ লাখ ইউরো পরিশোধ করতে হবে বার্সেলোনাকে। তা-ও সামনের যে কোনো দলবদলের সময়, মৌসুমের মাঝপথে এই জানুয়ারিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে ছাড়তে রাজি নয় ইন্টার। ফলের বার্সাও অত চেষ্টা করেনি লওতারোকে পাওয়ার, আগামী মৌসুমে হয়তো করবে আবার।
কপাল খারাপ চিমি আভিলার। ছয় মাস আগেই সান লরেঞ্জো থেকে ওসাসুনায় যোগ দেওয়া এই আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার এর মধ্যেই সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে গোল করে ফেলেছেন ১১টি। ফর্ম দেখে প্রলুব্ধ হয়েছিল বার্সেলোনাও। কিন্তু দলবদল হওয়ার আগেই চোটে পড়ে মাঠের বাইরে চলে যান আভিলা। চোটাক্রান্ত খেলোয়াড়কে দলে নেওয়ার চেষ্টা আর কেন করবে বার্সা!
আর্নেস্তো ভালভার্দের জায়গায় বার্সার কোচ হিসেবে কিকে সেতিয়েন আসার পর থেকেই শুরু হয় লরেন মোরোনকে নিয়ে আলোচনা। সেতিয়েন যখন রিয়াল বেতিসের কোচ ছিলেন, তাঁর অধীনে বেশ ভালো খেলেছেন স্প্যানিশ এই স্ট্রাইকার। ফলে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে বার্সেলোনা চাইল গুরুর পাশাপাশি শিষ্যকেও নিয়ে আসতে। ২৫ লাখ পাউন্ডে দলবদলটা হয়নি পরে আর।
আর্সেনালকে দেওয়া বার্সার প্রস্তাবটা শুনলে অবশ্য মনে হতে পারে—সাহসের বলিহারি! আর্সেনালের মূল স্ট্রাইকার পিয়ের-এমেরিক অবামেয়াং, যাঁকে ঘিরে রচিত হয় আর্সেনালের কৌশল। তাঁকেই কিনা বার্সা চাইল ছয় মাসের জন্য ধারে! কিন্তু মৌসুমে এখন পর্যন্ত নিজেদের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে মৌসুমের মাঝপথে কেন ছাড়বে গানাররা! সে দলবদল চেষ্টাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এরপর বার্সার নজর পড়ল ভ্যালেন্সিয়ার স্প্যানিশ স্ট্রাইকার রদ্রিগো মোরেনোর দিকে। তাকেও ছয় মাসের ধারেও চেয়েছিল বার্সা। কিন্তু ভ্যালেন্সিয়ার এক কথা, ৬ কোটি ইউরোর এক পয়সা কমেও রদ্রিগোকে ছাড়তে রাজি না তারা। রদ্রিগোর বার্সায় যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরে যাওয়া হয়নি এ কারণেই। ভ্যালেন্সিয়ার কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঠিক পর পরই আয়াক্সের সার্বিয়ান স্ট্রাইকার দুসান তাদিচকে ছয় মাসের ধারে চাইল স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা। লাভ হলো না সেখানেও।
রদ্রিগো-তাদিচকে না পেয়ে বার্সেলোনার অবস্থা যেন আরও সঙিন হয়ে উঠল। দলবদলের আর বেশি দিন বাকি নেই, স্ট্রাইকার লাগবে—বার্সেলোনা এবার বাধ্য হয়ে পছন্দটা ‘ইলিশ, পাঙাশ’ এর পর্যায় থেকে নামিয়ে ‘পুঁটি, কার্প’ এ আনল যেন। এভারটনের ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রিচার্লিসন, যিনি প্রতিভাবান হলেও কস্মিনকালেও ১০ কোটি ইউরো (সাড়ে ৮ কোটি পাউন্ড) দামের খেলোয়াড় ছিলেন না, তাঁর জন্য ১০ কোটি ইউরোর প্রস্তাব পাঠাল বার্সেলোনা। এভারটন আবার সেটি প্রত্যাখ্যান করেছে। বার্সার এত অঙ্কের প্রস্তাব দেওয়া, নাকি এভারটনের সেটি প্রত্যাখ্যান করা—কোনটি বেশি হাস্যকর, তা-ই বরং ‘বিতর্কে’র বিষয়। হাসিতামাশাও হচ্ছে এ নিয়ে। জনপ্রিয় বেটিং ওয়েবসাইট প্যাডি পাওয়ার যেমন লিখেছে, ‘এভারটনের রিচার্লিসনের জন্য বার্সেলোনা ৮৫ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। জেনে ভালো লাগছে অবশেষে কোনো ক্লাব নিজেদের দলবদলের পরিকল্পনা করছে সেই জনপ্রিয় মিম/ট্রলটার কথা মাথায় রেখে, যেখানে বলা হয়, ‘তোমার ফোনে এখন যত শতাংশ চার্জ আছে সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে তোমাকে এই খেলোয়াড়টিকে কিনতে হবে।’’
ওদিকে শোনা গেছে মোনাকোর ফরাসি স্ট্রাইকার উইসাম বেন ইয়েদেরের জন্য ৮ কোটি ইউরোর আরেকটা প্রস্তাব পাঠিয়েছে বার্সেলোনা। সাড়া আসেনি। এই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কার্যকরী স্ট্রাইকার, কিন্তু কোনো দিক দিয়েই এত দাম হওয়ার কথা না তাঁর।
ব্যাপারটা অনেকটা এমন দাঁড়িয়েছে, মাসের শুরুতে বেতনটা পকেটে পুরে অফিস শেষে রাতে মাছ বাজারে গেছেন। পকেটে টাকার অভাব নেই, কিন্তু বাজারে পছন্দের মাছের যথেষ্ট অভাব। না হলে ইলিশের দাম দিয়ে পুঁটি কেনার চেষ্টা কেউ করে!
এদিকে স্প্যানিশ ক্রীড়াদৈনিক স্পোর্ত খবর দিয়েছে, ইতালিয়ান ক্লাব সাসসুওলোর উইঙ্গার দমিনিকো বেরার্দির ব্যাপারেও আগ্রহ আছে বার্সার। এবার লিগে ১৬ ম্যাচে ৯ গোল করা এই উইঙ্গার অনেকটা রদ্রিগো মোরেনোর মতো খেলেন, আগ্রহের কারণ এটাই। পরে সেই আগ্রহও মিইয়ে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে রিয়াল সোসিয়েদাদের ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার উইলিয়ান হোসের ক্ষেত্রেও।
বার্সার খামখেয়ালিপনার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন কঙ্গোর স্ট্রাইকার সেডরিক বাকাম্বু। তেমন আহামরি কোনো স্ট্রাইকার নন তিনি, ভিয়ারিয়ালে তিন মৌসুমে মোটামুটি খেলার সুবাদে নজরে পড়েছিলেন চীনের ক্লাব বেইজিং গুয়ানের। রদ্রিগো-রিচার্লিসনদের না পেয়ে শেষমেশ চীন থেকে এই স্ট্রাইকারকেও আনতে চেয়েছিল বার্সেলোনা। বার্সার ফুটবল পরিচালক এরিক আবিদাল নিজেই ফোন করেছিলেন বাকাম্বুকে। বাকাম্বু তখন দুবাই থেকে কোরিয়ার সিউলে যাচ্ছেন দলের সঙ্গে। আবিদাল ফোন করে বাকাম্বুকে বার্সায় আসতে বললেন। দলবদলের শেষ দিনে বাকাম্বুকে বেইজিং গুয়ান থেকে ছয় মাসের ধার চুক্তিতে বার্সায় আনা হবে, এমনটাই পরিকল্পনা। ফলে সিউলে নেমে দলের সঙ্গে না গিয়ে উল্টো হংকংয়ের ফ্লাইট ধরলেন বাকাম্বু।
হংকংয়ে নামার পর আবার আবিদালের ফোন। যাত্রার মাঝপথে হংকং থেকে বার্সেলোনার ফ্লাইট ধরতে গিয়ে বাকাম্বু জানলেন, শেষ মুহূর্তে তাঁকে দলে নেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছে বার্সেলোনা। ফলে আবারও সিউলে ফিরতে হবে বাকাম্বুকে!
বাকাম্বু নিজেই এই ঘটনা জানিয়ে টুইট করেছেন। খেলোয়াড়দের তথ্য সংবলিত ওয়েবসাইট ট্রান্সফারমার্কেটকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আমার নামের পাশে দলবদলের জায়গায় লিখে দাও আমি প্রায় বার্সেলোনার খেলোয়াড় হয়ে গিয়েছিলাম। যা-ই হোক না কেন, আমার দলবদলের পুরো প্রক্রিয়ার ওপর সম্মান আছে। ঈশ্বর আমাকে যা দিয়েছেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট। বন্ধু আঁতোয়ান গ্রিজমান, পরে কখনো না হয় দেখা হবে তোমার সঙ্গে!’
বুঝুন বার্সেলোনার অবস্থা। ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা একটা দুর্দান্ত ক্লাবকে কীভাবে ‘সার্কাস’ বানিয়ে ফেলেন, বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধ হয় বার্সাই।
এদিকে শেষমেশ বার্সেলোনা রণে ভঙ্গ দিয়েছে। ক্লাবের এক পরিচালক ও সাবেক খেলোয়াড় গিয়ের্মো আমোর জানিয়ে দিয়েছেন, এ মাসে স্ট্রাইকার আনার জন্য আর চেষ্টা করবে না তারা। আগামী গ্রীষ্মে পর্তুগিজ স্ট্রাইকার ফ্রান্সেসকো ত্রিনকাওকে ৩ কোটি ইউরোতে দলে আনা হবে, এমনটা জানা গেছে।
কিন্তু স্ট্রাইকার আসুক বা না আসুক, বার্সেলোনার মতো ঐতিহ্যবাহী একটা ক্লাব দলবদলের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর যা করে বেড়াচ্ছে, ক্লাবের মূলমন্ত্র ‘মোর দ্যান আ ক্লাব (ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু)’ এর সঙ্গে সেটা সংগতিপূর্ণ কি না, সেটা কি আবিদাল-বার্তোমেউরা ভেবে দেখেছেন?