পরিসংখ্যানে বোঝা যায় না নির্যাতিত নারীর প্রকৃত সংখ্যা
by উদিসা ইসলামসাইয়েদার (ছদ্মনাম) চারবছরের সংসার জীবনের ইতি ঘটেছে ছয়মাস হলো। শুরু থেকেই স্বামী ও তার স্বজনদের অত্যাচারের শিকার সাইয়েদা একাধিকবার বাবা মাকে বলেছেন অশান্তির কথা। একদিন গায়ে অসংখ্য মারধোরের দাগ নিয়ে হাজির হন বাপের বাড়িতে। থানায় গিয়ে মামলা করার কথা বললেও দুই পরিবার একসঙ্গে বসে আবারও তাদের সংসারের পরামর্শ দেয়।
সাইয়েদাকে সংসারে নির্যাতন, তার পরিবারের পক্ষ থেকে নিস্ক্রিয়তা এবং মামলা করতে না দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো প্রায়ই অভিযোগ আকারে পাওয়া যায় বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। তারা বলছেন, কোনও একটি জরিপে হয়তো একটি চিত্র ফুটে ওঠে, কিন্তু সঠিক চিত্র আরও ভয়াবহ। আমরা সঠিক পরিসংখ্যান জানি না। কেননা বেশিরভাগ নারী এসব প্রকাশ করতে চায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর নারীরা এমন তথ্য প্রায়ই চেপে যান। তারা এও বলছেন, এসব আমরা কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারছি, এ বিষয়ে খুব নির্ভরযোগ্য গবেষণা এখনও করা সম্ভব হয়নি।
উম্মে হাবিবা বর্তমানে চাকরি করছেন না। তিন বছরের শিশুসন্তান, বাসায় অসুস্থ মা-সব মিলিয়ে বছর খানেক চাকরি চালিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে সামাল দিতে না পেরে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। একদিকে রোজকার সংসারের সব ঝক্কি সামলিয়ে নিজের জন্য সময় বের করতে পারেন না, আরেকদিকে আছে কথায় কথায় স্বামী ব্যাংকার রেজাউর রহমানের হাতে মারধোর। অথচ নিজের মায়ের সামনেও তার এই হয়রানির জীবন নিয়ে টু শব্দটি করেন না তিনি। গোপনে ফেলা চোখের জলই যেন সব অভিযোগ প্রকাশের ভাষা তার।
অভিযোগ না দেওয়ায় এমন অসংখ্য সাইয়েদা কিংবা উম্মে হাবিবার কথা কোথাও লিপিবদ্ধ হয় না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তৃণমূলের অভিজ্ঞতা বলছে, সংসার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় বেশিরভাগ নারীকে তার বাবার বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ি-দুই পক্ষ থেকেই নির্যাতনের কথা না বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনকি কথা বলতে গিয়ে দেখা গেছে, যেসব ঘটনা নির্যাতন হিসেবে গণ্য তেমন অনেক কিছুই নিত্যদিন তাদের সঙ্গে ঘটে যাচ্ছে অথচ সেগুলোকে নির্যাতন হিসেবে তারা চিহ্নিতই করেন না। নিজের সম্মানের কথা ভেবে কিংবা সন্তানের কথা ভেবে নির্যাতনের কথা লুকিয়ে যাচ্ছেন এমন ভিকটিমের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
পরিসংখ্যান যা বলে
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৭৮ জনকে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশই শিশু ও কিশোরী। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপের ফলাফল বলছে, দেশে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের শতকরা ৮০ জনই কোনও না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর হাতে। কিন্তু পারিবারিক সম্মানসহ বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে অধিকাংশ নারী এ নির্যাতন সহ্য করেন। আর শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের অর্ধেক চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান। বাকিদের চিকিৎসাসংক্রান্ত খবর জানা যায় না। নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়া বা চেপে যাওয়ার প্রবণতা বেশি।
কোনটি নির্যাতন সেটিই স্পষ্ট নয়
মানবাধিকারকর্মীরা তৃণমূলে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, জরিপ দিয়ে আসল সংখ্যা বোঝানো যাবে না। কেননা এগুলো প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে পাওয়া তথ্য। তৃণমূলের নারীরা যে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যায়, যেগুলোকে আমরা নির্যাতনের ক্যাটাগরিতে ফেলছি, সেগুলোকে তারা নির্যাতন হিসেবে চিহ্নিতই করতে পারেন না।
দীর্ঘদিন নিয়ে নারী নির্যাতন নিয়ে কাজ করছেন মানবাধিকারকর্মী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নারী অনেক কিছু যখন বাধ্য হয়ে করেন, সেটি যে তার ওপর নির্যাতন সেটি তিনি বুঝতে পারে না। তিনি ধরেই নেন এই কাজগুলো তারই করার কথা। কেননা তাকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়, তিনি স্বামীর নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। তার যে সেই নির্দেশ পালন করতে ইচ্ছে করছে না সেটিও তারই সমস্যা। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনগুলো নির্যাতন তা চিহ্নিত করতে না পারলেও নারী নির্যাতন যে হচ্ছে সেটি এখন ৯৮ শতাংশ নারী জানেন।
স্বামী ঠিকমতো সেবা না পেলে মারবে এমন ধারণা নিয়ে বাস করা নারী এই সমাজে বিরল নয় উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সামাজিক পরিবেশে নারীরা নির্যাতন নিপীড়ন অবহেলার বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। এর সামান্য অংশই কেবল পত্র-পত্রিকা বা থানা পর্যন্ত গড়ায়। আর মানবাধিকার সংস্থাগুলো নানা সময়ে যে পরিসংখ্যান দেয় সেটি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া। আমরা তখনই কেবল জানতে পারি যখন কিনা বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে যায় অথবা নারীর প্রতি সহিংসতা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃত ঘটনার প্রতিচ্ছবি এটা নয়। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
মুখ খোলেন না মধ্যবিত্ত নারী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মধ্যবিত্ত নারীর ক্ষেত্রে সবসময়ই পারিবারিক সম্মানের অদৃশ্য একটা পর্দা হাজির থাকে। সেকারণে স্বামী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হলে নারী কী করবেন সেটিও তার একক সিদ্ধান্তে হয় না। বিচার চাওয়া বা ঘর ছেড়ে আসবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সালিশি কায়দায়। আবার পরিবারের বাইরে নির্যাতনের শিকার হলে নানাভাবে তার চলাফেরা ও পোশাককে দায়ী করে রেহাই দেওয়া হয় আসল অপরাধীকে।
মধ্যবিত্ত নারীর চেপে যাওয়ার প্রবণতা বেশি উল্লেখ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জেন্ডার অ্যাডভাইজার বনশ্রী মিত্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মধ্যবিত্ত তাদের সম্মানটাকেই একমাত্র অর্জন মনে করে এবং মুখ খোলে না। এটা শিক্ষিত অল্পশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছে এমন নারীদের মধ্যে নির্যাতন প্রকাশ না করা এবং আমি ভালো আছি এটা দেখানোর প্রবণতা বেশি। ‘আমার স্বামী বলার আগে সব এনে হাজির করে’ স্টেটমেন্টের মধ্যে যে বঞ্চনা, স্বাধীনতাহীনতার বিষয় আছে এটা সে বোঝে না। তার সুখ স্বামীর আয়কেন্দ্রিক মনে করে। গণ্ডিটাকে ছোট করে রাখে। এর বাইরে ভাবতে শেখেনি। এই ভাবতে না শেখার কারণ ও করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যারা সচেতনতার কাজ করি তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছি। নারীর প্রতি সহিংসতা এমনই একটি বিষয় এটি শ্রেণি ধর্ম-বর্ণ কোনোকিছু মানে না। এই ইস্যু কমাতে চাইলে ঘরে ঘরে কাজ করা জরুরি। গণমাধ্যমের মাধ্যমে সবধরনের শ্রেণি পেশাজীবী মানুষদের কাছে পৌঁছানো বা স্কুল কলেজের পাঠ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চিন্তার জগত বদলানোর কাজগুলো করা খুব জরুরি।
মুখ খোলার জন্য যে ধরনের কাজ দরকার তা হয়নি উল্লেখ করে শীপা হাফিজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যে গবেষণাগুলো হয় সেগুলো সংখ্যায় যত অর্থবরাদ্দ পায়, মানসিকতা পরিবর্তনে কাজ করার বিষয়ে সেই পরিমাণ পায় না। একেবারেই কাজ হয়নি বললেই চলে। এই দায়িত্ব দিন শেষে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে যাতে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। সঠিক উপায়ে কাজ করলে এটা সম্ভব।