যুক্তরাষ্ট্রের উইঘুর বিল আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন ॥ চীন
অনলাইন ডেস্ক ॥ চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মার্কিন পার্লামেন্টে বিল পাস হওয়াকে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বেইজিং। একইসঙ্গে এ ঘটনাকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পষ্ট হস্তক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে দেশটি। সোমবার বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে চীনের এমন অবস্থানের কথা জানান জিনজিয়াং প্রদেশে সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নর শোহরাত জাকির। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স।
চীনে প্রায় দেড় কোটি উইঘুর মুসলমানের বাস। জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই উইঘুর মুসলিম। এই প্রদেশটি তিব্বতের মতো স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছে, সেখানে বসবাসরত উইঘুরসহ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে বেইজিং। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ ও অ্যাক্টিভিস্টরা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছেন, জিনজিয়াং-এর বিভিন্ন বন্দিশিবিরে অন্তত ১০ লাখ মুসলিমকে আটক করে রেখেছে চীন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জাতিসংঘের কাছে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে চীন বরাবরই মুসলিমদের গণগ্রেফতারের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
উইঘুর নির্যাতন নিয়ে মার্কিন পার্লামেন্টে বিল উত্থাপন করাকে নোংরা প্রচারণা হিসেবেও আখ্যায়িত করেন এই চীনা কর্মকর্তা। তার দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী নীতির সঙ্গে উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে চীনা নীতির কোনও পার্থক্য নেই।
শোহরাত জাকির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র জিনজিয়াং-এর সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখার নীতি বেছে নিয়েছে। তারা এ অঞ্চলের বিরুদ্ধে একটি তীব্র অভিযান চালাচ্ছে এবং চীনের জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মতবিরোধের বীজ বপনের জন্য এ বিষয়গুলো ব্যবহার করছে। কিন্তু তাদের এ ধরনের যে কোনও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এর আগে এ মাসের গোড়ার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং। তিনি বলেন, উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে মার্কিন পার্লামেন্টে পাসকৃত বিলের জন্য ওয়াশিংটনকে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে।
উইঘুর বিল পাসের ফলে চলমান বাণিজ্য আলোচনায় পড়বে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। তবে ওই বিলের সমালোচনা করে হুয়া বলেছেন, ‘এটা (বিল) জিনজিয়াংকে শাসন করার ক্ষেত্রে চীন সরকারের নীতির ওপর সহিংস আক্রমণ।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে এমন সময়ে বিলটি পাস হয়েছে যার কিছুদিন আগেই চীনের বন্দিশিবির বা নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে লাখ লাখ মুসলিমের মগজধোলাই তথা বিশ্বাস বদলে দেওয়ার নথি ফাঁস হয়। পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে এ ধরনের গোপন বন্দিশিবিরের কথা বেইজিং বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। চীনের দাবি, এগুলো আসলে কারিগরি প্রশিক্ষণ শিবির এবং মুসলিমরা স্বেচ্ছায় এখানে প্রশিক্ষণ নিতে গেছে। তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিআইজে যেসব ফাঁস হওয়া গোপন দলিলপত্র হাতে পেয়েছে, তাতে উঠে এসেছে কিভাবে এই উইঘুর মুসলিমদের বন্দি করে মগজধোলাই এবং শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
ধারণা করা হয়, চীনা বন্দিশিবিরগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। তবে উইঘুর টাইমস বলছে, এসব শিবিরে প্রকৃত বন্দির সংখ্যা ৩০ লাখ। ইয়ো জান নামের একজন সাবেক বন্দি জানিয়েছেন এ বন্দিশিবিরে তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ইতিহাস। তিনি জানান, তাকে রাতের বেলায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর এক বছর আটকে রাখা হয় কারিগরি প্রশিক্ষণ শিবির নামের কুখ্যাত বন্দিশিবিরে। তার ভাষায়, ‘ওরা আমাকে নগ্ন করে পায়ে শেকল পরিয়ে দিলো। ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ওরা আমাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতো না। সেখান থেকে জীবিত বেরিয়ে আসতে পারবো বলে ভাবিনি কখনো।’ ইয়ো জান তার যে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন, সেটাই বন্দিশিবিরে আটক আরও লাখ লাখ উইঘুর মুসলিমের কাহিনি।
বিশ্ব উইঘুর কংগ্রেসের আইনি উপদেষ্টা বেন এমারসন বলেন, চীন এখন বিশ্বের এক বড় পরাশক্তি। কিন্তু তারা নিজের জনগণকে আটকে রাখছে, যতক্ষণ না এসব মানুষ তাদের বিশ্বাস, ভাষা এবং নিজস্ব জীবনযাত্রা পুরোপুরি বদলে ফেলছে। এটাকে গণহারে মগজধোলাই ছাড়া অন্য কিছু ভাবা আসলেই কঠিন। একটি পুরো জাতিগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এই তৎপরতা চালানো হচ্ছে।