বিক্ষোভের মধ্যেই আজ পেশ হচ্ছে বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল

by

আজ সোমবার ভারতে লোকসভায় পেশ হতে চলছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে ভারতীয়দের একটা বড় অংশ। পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা আফগানিস্তান থেকে আসা অ-মুসলিমরা এ দেশে পাঁচ বছর বাস করলেই ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন। কিন্তু তাঁরা কোন দেশের নাগরিক ছিলেন বলে দাবি করবেন? বিশেষত যাঁদের জন্ম এ দেশে, তাঁরা নিজেদের অন্য দেশের নাগরিক হিসেবে তুলে ধরবেন কী করে? এই প্রশ্নই তুলছেন নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলনকারীরা।

অসমের নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) থেকে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ার প্রভাব এসে পড়েছিল এ রাজ্যেও। তাই আজ, সোমবার লোকসভায় পেশ হতে চলা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল নিয়ে উৎকণ্ঠায় এখানকার মানুষদের একটা বড় অংশ। বিলটি বিজেপি আনলেও তার বিরোধিতা করছে তৃণমূল, কংগ্রেস এবং বামেরা। সারা ভারত নমশূদ্র বিকাশ পরিষদের নেতা মুকুল বৈরাগ্যের বক্তব্য, ‘আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব মিলবে। কিন্তু আইনটি সংশোধনের পর কী শর্ত চাপানো হয়, তা নিয়েই আশঙ্কা থাকছেই।’ তিনি বলেন, ‘নাগরিকত্ব দেবে কেন্দ্রীয় সরকার বা তাদের নির্ধারিত সংস্থা। তবে সেখানেও নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কিছু শর্ত থাকবে, সে কথা বলা হয়েছে বিলে। সে ক্ষেত্রে কি নিজেদের বাংলাদেশি বা পাকিস্তানের নাগরিক বলতে হবে? একদিন যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল, সেই পরিবারগুলির বর্তমান সদস্যদের বেশিরভাগেরই জন্ম ভারতে। তাঁরা কী করে নিজেদের বাংলাদেশি বলে দাবি করবেন?’

বিলটির বিরোধিতা করছে উদ্বাস্তুদের সংগঠন ইউসিআরসি-ও। সংগঠনের নেতা মধু বাগ বলেন, ‘এক দেশ এক নীতির কথা বলছে বিজেপি।তা হলে ২০১৫-র যে সময়ে বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলগুলিকে বৈধতা দেওয়া হল, তাকে কেন মাপকাঠি ধরা হচ্ছে না? বিল পেশ হলে বিষয়গুলি স্পষ্ট হবে। ধর্মীয় কারণে উৎখাত হওয়া প্রমাণ করাও তো কঠিন কাজ।’ বিলে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত না-করা তাঁদের প্রতি বঞ্চনা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে মনে করছে মুসলিম সংগঠনগুলি। বিলের বিরোধিতায় ইতিমধ্যেই পথে নেমেছে তারা। এ রাজ্যের ১০ কোটি বাসিন্দার প্রায় তিন কোটিই মুসলিম। তা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তী বাংলাদেশ থেকে আসা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাও অন্তত ৭০ লক্ষ।

বিজেপির যুক্তি, প্রতিবেশী তিন রাষ্ট্র পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে গ্রহণ করেছে। তাই ধর্মীয় কারণে উৎখাত হওয়া সংখ্যালঘুদের ভারতে স্থায়ী ও নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অন্য দিকে কংগ্রেস, তৃণমূল, বামেদের বিরোধিতার মূল কারণ --- ধর্মীয় নিরিখে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কী ভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব? এত দিন যাঁরা এ দেশে বসবাস করছেন, তাঁরা কি দেশের বৈধ নাগরিক নন?

২০১৬-তে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনে লোকসভায় একটি সংশোধনী বিল পাশ করালেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-থাকায় তা রাজ্যসভায় পেশ করেনি বিজেপি। পরিবর্তে বিলটিকে পাঠানো হয়েছিল সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে। এ বারের পরিস্থিতি অবশ্য আলাদা।

নাগরিকত্বের প্রশ্নটি বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল। কারণ দেশভাগের কষ্ট এই রাজ্যগুলিকেই সরাসরি প্রভাবিত করেছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যতবারই বলেছেন, সারা দেশে এনআরসি হবে, ততই যেন আতঙ্ক গ্রাস করেছে এ রাজ্যে বসবাসকারী এক সময়ের উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে। সম্প্রতি রাজ্যের তিন উপনির্বাচনে সেই আতঙ্কের জেরেই বিজেপির ফল খারাপ হয়েছে বলে স্বীকার করছেন দলীয় নেতৃত্ব। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য বলছেন, ‘এই বিল সংসদে এলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে সরকারের উদ্দেশ্য। তাতে দল হিসেবে অবশ্যই লাভবান হবে বিজেপি। বিলটি পাশের পরে আমরা এ নিয়ে প্রচারে নামব।’ অন্য দিকে, তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই এনআরসির বিরোধিতা করে এসেছেন। রবিবার তৃণমূলের এক সংসদীয় দলের নেতাও জানান, বিলটি সংসদে পেশ হলে দলের তরফে তার বিরোধিতা করা হবে। এ বিষয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট।

কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘বিলের মধ্যে এমন কিছু থাকা কাম্য নয় যা সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উস্কানি দিতে পারে। কিন্তু প্রস্তাবিত বিলটিতে সেই সুযোগ থাকায় আমরা তা গ্রহণ করতে পারছি না।’ বিলে দু’টি সংশোধনী প্রস্তাব আনতে চাইছে বামেরাও। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, ‘তিন দেশকে আলাদা করে চিহ্নিত না-করে প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত এবং সব ধর্মের মানুষের কথাই বলতে হবে।