আলমারিতে ঘুমিয়ে সফল উদ্যোক্তা
by মো. মনিরুল ইসলামতিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। কিন্তু শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। প্রতিষ্ঠা পেতে দেশ ছাড়তে হয়েছে। পরবাসে কাটাতে হয়েছে একা, যেখানে তাঁর আপনজন বলতে কেউ ছিলেন না। শুধুই একাকিত্ব। বন্ধু পাওয়ার জন্য ছিলেন মরিয়া।
আরও ছিল আবাসনসংকট। জায়গা না পেয়ে টানা তিন মাস কাটাতে হয়েছে একটি আলমারিতে। সেখানেই হাওয়াই বিছানায় ঘুম। বাকিটা সময় কাজ আর কাজ। এভাবেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন নরওয়ের সফল উদ্যোক্তা ম্যাথিয়াস মিক্কেলসেন।
বিবিসির জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘দ্য বস’। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়িক নেতার উঠে আসার গল্প তুলে ধরাই এ অনুষ্ঠানের প্রধান কাজ। চলতি সপ্তাহে আলোচনা হয়েছে ম্যাথিয়াসকে নিয়ে। তিনি দেশটির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘মোমোরি’র প্রতিষ্ঠাতা।
ব্যবসার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির জন্য জীবনের প্রথমভাগে এই মানুষটি এতটাই মরিয়া ছিলেন যে একসময় তিনি টানা তিন মাস আলমারিতে ঘুমিয়েছিলেন।
গল্পে ঢুকতে হলে ফিরে যেতে হবে ছয় বছর আগে, ২০১৩ সালে। ২৩ বছরের তরুণ উদ্যোক্তা ম্যাথিয়াস উড়াল দিলেন দূর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। ঘাঁটি গাড়লেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে। সম্পূর্ণ নিজ খরচে। লক্ষ্য ছিল একটাই—তাঁর অনলাইন প্রকল্প ও সময় ব্যবস্থাপনার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যবসার জন্য সমর্থন আদায় করা। প্রকল্পটির নাম ছিল ‘টাইমলি’।
সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ায় গিয়ে শুরুতেই বড় একটি সমস্যায় পড়তে হয় ম্যাথিয়াসকে। সেখানে এমন একজনও পাননি, যাঁকে তিনি চেনেন, জানেন। তবু তিনি সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘সে সময় নরওয়েতে প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা শুরু করার মতো অবস্থা ছিল না। তাই আমি বিশ্বের প্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত সিলিকন ভ্যালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এটা ভেবে যে এটাই হবে আমার জীবনের জন্য সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত।’
দূর পরবাসে একলা জীবনের অবসান ঘটাতে একটি সুচতুর পরিকল্পনা করলেন ম্যাথিয়াস। তিনি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকা এবং প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। টোটকাটা কাজে লাগল। বন্ধু জুটতে থাকল তাঁর। ম্যাথিয়াস বললেন, ‘এভাবেই আমি বন্ধু বানাতে থাকলাম।’
পরিকল্পনাটি ভালোভাবেই কাজে লেগেছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ম্যাথিয়াসের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বন্ধু জুটে গেল। কিন্তু এরপরের চ্যালেঞ্জটাও ছিল কঠিন। একটি ‘হ্যাকার হাউস’ জোটানো। এটি সমমনা তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের একটি আবাস, যেখানে অবস্থানকারী সবাই নিজ নিজ প্রকল্পকে ব্যবসায় রূপান্তর করতে চান। এই আবাসে সবাই সবাইকে সমর্থন জোগান, আদান–প্রদান করেন নিজের পরামর্শ, অনুপ্রেরণা ও যোগাযোগ।
শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সিলিকন ভ্যালিতে একটা আবাস খুঁজে পেলেন ম্যাথিয়াস। সেখানে ঘটল আরেক বিপত্তি। ১৫টি বিছানার সব কটি অন্যরা নিয়ে গেলেন। তাই তাঁকে সেখানে থাকতে হলে একটি আলমারি ছাড়া উপায় নেই। সেখানে থাকতে হবে হাওয়াই বিছানায়। নেই জানালা।
বর্তমানে ২৯ বছরের ম্যাথিয়াস বললেন, ‘আমি সুযোগটি লুফে নিলাম। সেই আলমারিতে তিনটা মাস কাটিয়ে দিলাম। সেখানে ঘুমাতে আমার মোটেও খারাপ লাগেনি। একদমই না।’
এই হ্যাকার হাউসই বদলে দেয় ম্যাথিয়াসের জীবন। সেখানে থাকাটার অভিজ্ঞতা ছিল অসামান্য। সেখানে থেকেই তিনি প্রকৃত উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘আসলেই এটা ছিল খুবই বড় ব্যাপার, যার কোনো মূল্য নেই। সেখানে না থাকলে আজকে আমি যা তা হতে পারতাম না।’
খুব দ্রুতই ম্যাথিয়াসের ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। তাঁর টাইমলি অ্যাপ আজ বিশ্বের ১৬০টি দেশের পাঁচ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে।
নরওয়ের উত্তরাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করলেও ম্যাথিয়াসের বেড়ে ওঠা রাজধানী অসলোর বাইরের একটি শহরে। শৈশবে স্বপ্ন ছিল একজন পেশাদার ফুটবলার হবেন। খেলবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। কিন্তু কৈশোরে এসে তাঁর মত বদলায়। তিনি আবিষ্কার করলেন, ফুটবলের চেয়ে তাঁর মস্তিষ্ক বেশি কাজ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করা অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করলেন। এ জন্য অর্থও পেলেন। তবে প্রথম দিকে এ কাজে তাঁর মা-বাবা খুশি ছিলেন না, যে পর্যন্ত না তিনি হাতে চেক পেলেন।
২০১৪ সালের শেষের দিকে ‘টাইমলি’ নিয়ে এগোতে থাকেন ম্যাথিয়াস। এক বছর পর তিনি তাঁর ব্যবসাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অসলোতে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন। নতুন করে নাম দিলেন ‘মেমোরি’। ম্যাথিয়াস বলেন, ‘আমি যখন দেশ ছাড়ি, তখন এই শহরে প্রযুক্তি ব্যবসা চালু করার মতো অবস্থা ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য অসলো এখন দারুণ জায়গা।’
মেমোরির এখন ৪৫ জন কর্মী। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিক্রির হার ২০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। ম্যাথিয়াস তাঁর ব্যবসার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছেন ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
সাহস আর সুযোগের সদ্ব্যবহারের কারণেই আজ এত দূর ম্যাথিয়াস, বললেন যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা বিষয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান মর্গান। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে ম্যাথিয়াসের মতো উদ্যোক্তাদের কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাঁরা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। সুযোগ পেলে লুফে নেন।’
সত্যিই, সহজাত বৈশিষ্ট্য আর সুযোগ কাজে লাগানোর কারণেই আজকে সুপ্রতিষ্ঠিত ম্যাথিয়াস। তবে সিলিকন ভ্যালির সেই হ্যাকার হাউসের দিনগুলো আজও ভোলেননি তিনি। বললেন, ‘এটা ছিল সত্যিই উথাল–পাতাল একটা সময়। তবে খুবই সুস্থির। আমি প্রতিদিন প্রতিটি মিনিট কাজে লাগিয়েছি। তাই সত্যি বলতে, সেই তিনটা মাস আমি কোথায় ঘুমিয়েছিলাম, তা আমার মাথাতেই ছিল না।’ তথ্যসূত্র: বিবিসি।