আফগানিস্তানে শান্তি কি আদৌ ফিরবে?
by ইহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদমার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী এবং আফগান সেনাবাহিনী গত মাসে একটি নজিরবিহীন জোট গঠন করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, আইএসের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রমী ও বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করা। এই জোটের সেনারা পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে নানগারহারে ইসলামিক স্টেট খোরাসানের (আইএস–কে) উত্থানকে রোধ করতে তালেবানদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, যেখানে মিলিশিয়া-নিয়ন্ত্রিত বিশাল গ্রামাঞ্চল রয়েছে। সম্মিলিত সামরিক আক্রমণের ফলে আইএস-কের অবস্থা এখন দৃশ্যত সঙিন। তালেবানরা কয়েক সপ্তাহ ধরে আইএস–কের ঘাঁটিগুলোয় খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের পথগুলোকে রোধ করে রাখে এবং একই সময় ন্যাটো ও আফগান সেনাদের জোট তাদের অবস্থানে বিমান হামলা চালায়। হামলার কারণে আইএস–কে যোদ্ধাদের তৎপরতা সীমিত হয়ে পড়ে এবং পাঁচ শতাধিক সদস্য জোটের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, যাঁদের অনেকেই বিদেশি। তবে অনেকেই পালিয়ে যান।
গত বুধবার মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদ আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আইএস–কের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক হামলায় তালেবানের ভূমিকা স্বীকার করে একটি টুইটে প্রকাশ্যে ন্যাটো-আফগান সেনা জোটকে সমর্থন করেন। হোয়াইট হাউসের এই বিশেষ দূত লিখেছেন, নানগারহারের সাম্প্রতিক অভিযান হচ্ছে একটি উদাহরণ। মার্কিন জোট ও আফগান নিরাপত্তা বাহিনী এবং তালেবানের কার্যকর অভিযানের ফলে আইএস-কে তাদের এলাকা ও যোদ্ধাদের হারিয়েছে। কয়েক শ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে আইএসের অন্যতম ভয়ংকর সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্যতম আইএস-কের প্রথম উত্থান ঘটে। ২০১৩ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় হাকিমুল্লাহ মেহসুদ নিহত হওয়ার পর কয়েক হাজার পাকিস্তানি তালেবান তাদের নতুন নেতাকে পরিত্যাগ করে নানগারহারে চলে যায়। তারাই একপর্যায়ে আইএস-কেতে যোগ দেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেওয়ার পর আফগানিস্তানজুড়ে তালেবানের নেতৃত্বাধীন হামলা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ওয়াশিংটন তখন শান্তি চুক্তি করেনি। কারণ, তালবানরা আত্মবিশ্বাস তৈরির ব্যবস্থা হিসেবে তাদের হামলা বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এখন উভয়ই আরও সমন্বয়মূলক মনোভাব গ্রহণ করছে এবং আলোচনা আবার ট্র্যাকে ফিরে এসেছে। একটা শান্তিচুক্তি হয়তো হবে। কিন্তু তাতে কি আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে আসবে? আইএস-কেকে কি আদৌ নির্মূল করা যাবে?
জোট বাহিনী ও আফগান বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে আইএসের সঙ্গে লড়াই করছে। তারা নানগারহারে আইএস-কের একটি আস্তানায় শক্তিশালী বোমা হামলা চালিয়েছে। কিন্তু সবই বিফল হয়েছে। দমানো যায়নি আইএস-কেকে। আইএস–কের কমান্ডাররা ইতিমধ্যেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের মধ্যে যদি কোনো ধরনের শান্তিচুক্তি হয়, তাহলে ইসলামি আমিরাতের অসন্তুষ্ট সমর্থকেরা আইএস–কেতে যোগ দেবে।
গত আগস্টে এক টেলিগ্রাম কথোপকথনে আইএস-কের এক কমান্ডার বলেছেন, ‘আমরা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী যে একটি শান্তিচুক্তি আমাদের পক্ষে জনশক্তি ও তহবিল অর্জনের ক্ষেত্রে উপকারী প্রমাণিত হবে। তালেবানের ফিল্ড কমান্ডার ও যোদ্ধারা এতে সম্মত হবে না। তারা ক্ষমতার ভাগাভাগির ধারণা মেনে নেবে না। আফগানিস্তানে পুরোপুরি খাঁটি ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠার জন্য তারা বহু বছর ধরে লড়াই করে আসছে। কোনো কিছু কম পড়লে তা তাদের আমাদের দলে যোগদানের জন্য উৎসাহী করবে। তালেবান ফিল্ড কমান্ডারদের মধ্যে অসন্তুষ্টি এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এবং আমরা এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছি।’
তালেবান নেতৃত্বের জন্য আইএস–কেকে নির্মূল করা কৌশলগত দিক দিয়ে জরুরি। তারা কাদের পক্ষে রয়েছে, সেটা বিবেচ্য নয়। ওয়াশিংটন ও কাবুলের সঙ্গে কোনো চুক্তি করার আগে যদি আইএস–কেকে নির্মূল না করা যায়, তবে আইএস–কে তালেবানের মধ্যে থাকা কট্টরপন্থী উপাদানগুলোকে পক্ষ বদলানোর সুযোগ দিতে পারে। ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সম্ভাব্য চুক্তিতে অসন্তোষ ছাড়াও স্থানীয় উপজাতিদের উপদ্রব থেকে বাঁচার প্রয়োজনীয়তা থেকেও তালেবানরা আইএস-কেতে যোগ দিতে পারে। কেন্দ্রীয় তালেবান নেতৃত্ব এখনো আশঙ্কা করছেন যে ফিল্ড কমান্ডাররা, বিশেষ করে প্রথম সারির সেনারা ১৮ বছর ধরে যে বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে, তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।
ব্যাপক হামলা চালানো সত্ত্বেও আইএস-কে কার্যকরভাবে দুর্বল হয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তাদের আদৌ দুর্বল করা যাবে কি না বা আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল থেকে নির্মূল করা যাবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আফগান শান্তিপ্রক্রিয়াকে যদি এগিয়ে নেওয়া না যায় এবং তালেবানের বিভিন্ন গ্রুপের নেতাদের যদি ঐক্যবদ্ধ করা না যায়, তাহলে বহু তালেবান নেতার আইএস-কেতে যোগ দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শান্তিপ্রক্রিয়া ও যুদ্ধ বন্ধের বিরোধী তালেবান যেসব নেতা আইএসে যোগ দিচ্ছেন, তাঁরা যদি ঐক্যবদ্ধ হন, তাহলে তা আফগানিস্তানের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এ রকম হলে আফগানিস্তানে শান্তি কখনোই ফিরে আসবে না।
দ্য ন্যাশন পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদ: পাকিস্তানি সাংবাদিক