বেলাই বিলের বালুর বাঁকে
by জাকারিয়া মণ্ডলবিলের নাম বেলাই। তার বুকে দ্বীপের মতো গ্রাম। কোথাওবা একটি বাড়ি নিয়েই দ্বীপবাড়ি। পুরো বিলজুড়ে গিজগিজে কচুরিপানা। সেগুলোর ভেতর বিশেষ এক প্রজাতির পানায় চোখ আটকায়। দেখতে ঠিক যেন কাগজের ফুল। গাদা গাদা চেনা কচুরিপানার সঙ্গে গলাগলি করে বিলের বুকে ভাসছে।
ফাঁকে ফাঁকে শাপলা। লাল, সাদা। কোনোটা ফুটছে। কোনোটা আবার পুরোপুরি ফুটে বিলের জলে মেলে রেখেছে নিজেকে।
এখানে ওখানে জাল পাতা। মাছ তুলে খলুইয়ে ভরছেন নিঃসঙ্গ মাঝি।
দ্বীপ গ্রামের পাশে পানিতে দাপিয়ে চলেছে ন্যাংটো শিশুর দল। সাঁতরে এসে ইঞ্জিন নৌকায় উঠছে। গলুইয়ের ওপর উঠে লাফিয়ে পড়ছে ফের। বাড়ির ঘাটে গেরস্থালি সারছে বউ, মেয়েরা। গরু নিয়ে গৃহস্থ নেমেছে বেলাই বিলে। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জলাশয় কয়েক শতাব্দী ধরে বুকে আগলে রেখেছে বালু নদীকে।
ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, ‘চারিশত বৎসরের পূর্বে এই বিলমধ্যে কোনো গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। তৎকালে এই বিলটি একটি খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল।’
স্থানীয় এক ভাটের গানে বেলাই বিলের জন্ম বিষয়ে এক প্রবাদে বলা হচ্ছে–
‘নানা স্থানে স্থানে শুভক্ষণে পুষ্কর্ণি কাটিল
বেলাই বিল শুষ্ক করি নিজ প্রতাপ দেখাইল।’
এই প্রতাপ দেখানো লোকটি হলেন খটেশ্বর ঘোষ। তিনি তখন ভাওয়ালের ভূস্বামী। এই স্রোতস্বিনীর খরস্রোতে তার এক ছেলে ভেসে যায়। খটেশ্বর তখন ৮০টি খাল কেটে নদীজল নিঃশেষ করে ফেলেন। তাতে খরস্রোতের প্রণালি পরিণত হয় প্রকাণ্ড বিলে।
গোটা বিলেই পাখির বিচরণ। বাজ, চিল, বক, মাছরাঙার মেলা। পাশ ঘেঁষে নৌকা গেলেও খুব একটা গা করছে না শিকারি পাখিগুলো। গরুর জন্য নৌকা বোঝাই কচুরিপানা নিয়ে ফিরছে মাঝি। একই অঙ্গে কত যে রূপ মেলে আছে বেলাই!
এ বিলের পূর্ব অংশে বক্তারপুর গ্রাম। যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, এ স্থানেই ঈসা খাঁ বাস করতেন। জনশ্রুতি বলছে, ঈসা খাঁ যখন এ স্থানে থাকতেন, তখন তার সঙ্গে থাকতো অনেক বজরার বহর। ওই বজরা থেকে জায়গার নাম হয় ‘বজরাপুর’ বা ‘বজ্রাপুর’। কালের বিবর্তনে তা ‘বক্তারপুর’ রূপ নেয়। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বক্তারপুরে অসুস্থ ঈসা খাঁ’র মৃত্যু হয়।
সম্প্রতি বক্তারপুর বাজারের পাশে ঈসা খাঁ’র সমাধি চিহ্নিত করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। বক্তারপুর বাজার থেকে সমাধি পর্যন্ত রাস্তাটির নাম রাখা হয়েছে ঈসা খাঁ রোড। পুরো রাস্তাতেই ছায়া ছড়িয়ে রেখেছে কাঁঠাল, আম, শিশু গাছ। সমাধির ওপরেও গাছ-আগাছার রাজত্ব। মাথার দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে খেজুর গাছ। উপজেলা প্রশাসন স্থানটি প্রাচীরে ঘিরে দিয়েছে।
ওখান থেকে বেলাই বিলে বৈঠা ঠেলে অল্প সময়েই বালুর প্রবাহে চলে আসা যায়। উজানে কাপাসিয়ার কাছে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সংযোগ গড়া সুতী নদী এখন প্রায় মৃত। শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর মধ্যবর্তী অববাহিকার সব পানি মূলত বেলাই হয়েই বালুতে নামে। এখনও বারো মাসই নাব্য থাকে বালু নদী।
পূবাইল বাজার পশ্চিমে রেখে বেলাই বিলের সঙ্গ ছেড়েছে বালু। তারপর নিঃসঙ্গ জলধারা এগিয়েছে দক্ষিণে। দড়িপাড়ার কাছে পাশাপাশি নদীর ওপর গ্যাঁট হয়ে বসা তিনটি সেতু। একটি সড়ক সেতু, টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়ক। আর একটি রেল সেতু। অন্যটি পুরনো রেল সেতু। আরও ভাটিতে আরও একটি সেতু, ঢাকা বাইপাস সড়ক। এখানে নদীর পূর্ব তীরে উলুখোলা, দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষিপণ্যের বাজার।
আরও ভাটিতে উত্তর-পশ্চিম থেকে তুরাগ নদী এসে বালুতে মিশেছে। জায়গাটার নাম ‘তেরমুখ’। নদীসঙ্গমে লম্বাটে এক দ্বীপ। তার ওপর দিব্যি জেঁকে বসেছে ইটের ভাটা। চিমনির ধোঁয়া তেরমুখের আকাশে অনেকদূর পর্যন্ত গলা বাড়িয়ে ভাসছে। ভাটার পাশ দিয়ে সেতু পেরোনো ধারাটা কিছু দূর পর্যন্ত সাদা। শিল্পবর্জ্য বয়ে আনা তুরাগের কালো ধারাটাকে সহসাই নিজের বুকে মিশতে দেয়নি বালু। পাশে নিয়ে ছুটেছে খানিক। একসময় আর পারেনি। বালুর সাদা বিলীন হয়ে গেছে তুরাগের কালো থাবায়।
আরও এগিয়ে ঢাকা জেলার সীমানায় ঢুকেছে বালু। পূর্ব পাড়ে পূর্বাচল সিটি, তার নিচে ঈসাপুরা। শ্মশানঘাটের কাছে একটা দ্বীপ। গোটা দ্বীপই ইটভাটার দখলে। শ্মশানটা বোধ হয় এখন আর চালু নেই। বিশাল একটা গাছ ঝুঁকে এসেছে নদীর ওপর। তার ছায়া মেখে ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানার দঙ্গল।
একটু ভাটিতে ঈসাপুরা বাজার। নদীর ওপরে লোহার সেতু। আরও ভাটিতে বালু থেকে একটা শাখা এগিয়েছে পশ্চিমে। একটু এগিয়ে যার নাম হয়েছে রামপুরা খাল, আরও সামনেরটা এখনকার হাতিরঝিল। একসময় এর নাম ছিল নড়াই নদী। জেমস রেনেলের মানচিত্রে যা ‘নেড়ি খাল’ নামে চিহ্নিত। ওই নড়াই ত্রিমোহিনীতে যেখানে বুড়িগঙ্গামুখী দেব ধোলাইয়ের জন্ম দিয়েছে, সেখান থেকে বালু নদীর দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত নৌকা চলে এখনও।
দক্ষিণ পাড়া থেকে আর একটু ভাটিতে বেরাইদ গ্রাম। এই এক গ্রামই একটা ইউনিয়ন। অন্তত ২৫টি মসজিদ আছে এখানে। বেরাইদ তাই মসজিদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। ঊনিশ শতকের একটি স্কুলও আছে এখানে। আছে আরও কিছু পুরনো স্থাপনা। সবচেয়ে পুরনো মসজিদটিতে সুলতানি আমলের নির্মাণশৈলী। প্রায় সমতল ছাদের ওপরে গম্বুজ। মসজিদটি ১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বলে লিখে রেখেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এর আদি কাঠামো এখনও অটুট। তবে ভেতরের দিকে টাইলসে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এখান থেকে যত ভাটিতে নেমেছে, বালু অববাহিকায় হাউজিং কোম্পানির সাইনবোর্ড ততই বেড়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়ায় বালু থেকে বের হওয়া ধোলাই নদীর মুখ চিহ্নিত করাই মুশকিল! অথচ সুদূর অতীতে এই ধোলাই ছিল বালুর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ স্থাপনকারী নদী। খরস্রোতা। সেই স্রোতে ধরে রাখলে আপনাআপনি ধোয়া হয়ে যেতো মসলিন কাপড়। ওই নদীর নাম তাই ‘ধোলাই’ হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
চনপাড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে ডেমরায় শীতলক্ষ্যায় মিশেছে বালু। যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, ‘বিক্রমপুরাধিপতি কেদার রায়কে পরাজিত করে মানসিংহ শিবির পাতেন ডেমরায়। কিছুদিন থাকেন। ঈসা খাঁর সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়।’
তবে বস্ত্র-বাণিজ্য, বিশেষ করে জামদানির জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল ডেমরা। ‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’ গ্রন্থে তোফায়েল আহমদ লিখেছেন, ‘ডেমরা হলো উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিল্পকর্ম জামদানি শিল্পের প্রাচীন কেন্দ্র। ফারসি শব্দ জামা মানে কাপড়, দানা অর্থ বুটি। জামদার মানে ফুল বা বুটি তোলা। এ কাপড়ে ফুল বা বুটি তোলা হতো বলে তার নাম হয় জামদানি।’
এখানকার জামদানি পল্লী এখনও সেই গৌরবময় অতীতের সাক্ষী। এখানে হাট গমগম করে প্রতি শুক্রবার। বিকিকিনি শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। দ্বিতীয় প্রহরে দিন গড়াতে না গড়াতেই সাঙ্গ হয় জামদানির হাট।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক