দেশভাগের বিরোধী ছিলেন মাওলানা আজাদ
by খায়রুল আনামমাওলানা আবুল কালাম আজাদ—এই নামে সবাই জানলেও তাঁর প্রকৃত নামটি কিন্তু বেশ বড়। মাওলানা সাইয়েদ আবুল কালাম গুলাম মহিউদ্দিন আহমেদ বিন খায়রুদ্দিন আল হুসাইনি আজাদ। তাঁর জন্ম ১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর, আরবের মক্কায়। তখন মক্কা তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। আজাদের দাদা অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় তাঁর পণ্ডিত বাবা নিজের নানার সঙ্গে দিল্লিতে বসবাস করতেন। তাঁর বাবা নিজেও একজন পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের (ইন্ডিয়ান মিউটিনি) সময় তিনি ভারত ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান। তিনি ১২টি বই লেখেন। তাঁর হাজার হাজার শিষ্য ছিল। আজাদের মায়ের নাম শায়িখা আলিয়া বিনতে মোহাম্মদ। মদিনাবাসী এই নানা, মোহাম্মদ নিজেও একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন যাঁর সুনাম আরবের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
মাওলানা আজাদের পরিবার ১৮৯০ সালে ভারতে ফিরে এসে কলকাতায় বসবাস শুরু করে। কোন স্কুলে নয়, তিনি বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করে বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ফারসি, আরবি এবং ইংরেজিতে দক্ষতা লাভ করেন। গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি ইসলামের চার মজহাব, গণিত, দর্শন, বিজ্ঞান ও পৃথিবীর ইতিহাস সম্বন্ধে পড়াশোনা করেন। ১২ বছর বয়সে ছোটদের পড়ায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য একটি লাইব্রেরির ব্যবস্থা করেন, নিজে ‘নাইরঙ্গী এ আলম’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ও ‘আল মিসবাহ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও কালামের তর্জমা এবং সম্পাদনা করেন। তেরো বছর বয়সে জুলাইখা বেগম নামে একজন মুসলিম কন্যাকে বিয়ে করেন।
বিপ্লবী ও সাংবাদিক জীবন: মুসলমান হলেও ধর্মের বদলে সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদী আজাদ পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী ভারতীয় (ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট) হয়ে যান। তিনি জাতিগত বৈষম্য উসকে দেওয়ার জন্য এবং সারা ভারতে সাধারণ মানুষের দাবি ও প্রয়োজন উপেক্ষা করায় ইংরেজদের অত্যন্ত তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। জাতীয় ইস্যুর আগে সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে বড় করে দেখায় তিনি মুসলিম রাজনীতিবিদদেরও সমালোচনা করেন। আজাদ স্যার সৈয়দ আহমদের ‘ন্যাশনালিস্ট’ আইডিয়ার প্রতি অনুরক্ত হন। ১৯০৮ সালে তিনি ইরাক, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক ও ফ্রান্স ভ্রমণ করেন ও তাদের যুব সমাজের মধ্যে কামাল আতাতুর্কের ধর্ম ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও জাতীয়তাবাদী মতবাদ তাঁকে প্রভাবিত করে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের মতবাদের বিপরীতে অবস্থান নেন। এ সময় তিনি হিন্দু বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ ও শ্যাম সুন্দর চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসেন।
ধর্মের বদলে রাজনীতিতে মাওলানা আজাদের অনুরাগ দেখে মাওলানা শিবলী নোমানী তাঁকে ‘ওয়াকিল’ পত্রিকার সম্পাদক অমৃতসরের খান আতার কাছে পাঠান। সেখানে তিনি সম্পাদকমণ্ডলীর সভ্য হিসেবে পাঁচ বছর কাটান। কলকাতায় ফিরে ১৯১২ সালে তিনি ‘আল-হিলাল’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা বের করেন। এতে ব্রিটিশ পলিসিকে আক্রমণ ও সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশরা প্রেসের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে এই পত্রিকা ১৯১৪ সালে বন্ধ করে দেয়। পত্রিকার প্রধানত দুটি লক্ষ্য ছিল ১. মুসলিম তরুণদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা ও ২. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। এরপর তিনি একই আদর্শের ‘আল-বালাঘ’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। একই সময় তিনি খিলাফত আন্দোলনকেও প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেন। এই আন্দোলন হলো ব্রিটিশদের বিপক্ষে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানকে সমর্থন করা। সে সময় তুর্কি সুলতানকে মুসলিম জাহানের খলিফা বলা হতো। খলিফার পক্ষের এই আন্দোলন তাই খিলাফত আন্দোলন। আজাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাচ্ছে দেখে ব্রিটিশরা ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া রেগুলেশান অ্যাক্ট’-এ ফেলে তাঁর দ্বিতীয় পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেয়। তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও বোম্বে প্রেসিডেন্সি, ইউনাইটেড প্রভিন্স, পাঞ্জাব ও দিল্লি প্রদেশে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। তাঁকে রাঁচির জেলে ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তরীণ রাখা হয়।
সাহিত্যকর্ম: মাওলানা আজাদ অনেক বই লিখেছেন যাদের মধ্যে বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছ ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম, ঘুবার-এ খাতির, তাযকিরাহ, তার্জিমানুল কোরআন ইত্যাদি। ঘুবার-এ খাতির তাঁর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বইয়ের অন্যতম। মূলত ২৪টি চিঠির সমষ্ঠি নিয়ে লেখা এই বইটি তিনি ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলে বসে লিখেছিলেন। ২/১টি চিঠি ছাড়া বাকি সব জটিল বিষয়ের ভাবনা নিয়ে লেখা। যেমন—ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ধর্মের উৎপত্তি, সংগীতের উৎপত্তি ও ধর্মে তার স্থান। চিঠিগুলো তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু মাওলানা হাবিবুর রহমান খান শেরোয়ানীকে উদ্দেশ্য করে লেখা। কিন্তু কারাগারের ভেতর থেকে সেগুলো পাঠানোর অনুমতি ছিল না। ১৯৪৬ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে উর্দু ভাষায় লিখিত ওই চিঠিগুলো তিনি তাঁর বন্ধু আজমল খানকে দেন। আজমল খান অল্পদিনের মধ্যে সেগুলো প্রকাশ করেন। তাঁর অন্য দুই পাঠকপ্রিয় বইয়ের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও ‘ঘুবার এ খাতির’ তাঁর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিফলন।
প্রাক–স্বাধীনতা ও অসহযোগ আন্দোলন: ১৯১৯ সালের ‘রাইলাট অ্যাক্ট’ পাস হওয়ার পর ভারতীয়দের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার নির্মমভাবে সীমিত করা হয়। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে পাঠানো হয় ও পত্রপত্রিকা বন্ধ করা হয়। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র অসহায় নাগরিকদের হত্যা করা হলে সারা দেশে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। ব্রিটিশদের একনিষ্ঠ ভারতীয় সমর্থেকরাও এতে বেঁকে বসে। এ সময় খিলাফত আন্দোলনও চরমে ওঠে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির মহাত্মা গান্ধী খিলাফত আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে হাত মেলান এবং হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে একটি ব্রিজ তৈরির উদ্যোগ নেন। এতে আজাদ ছাড়া খিলাফতের অন্যান্য প্রধান নেতা যেমন মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গান্ধীর সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলন ও হিন্দু-মুসলিম একাত্মতায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন।
বিদেশি সামগ্রী, বিশেষ করে বিদেশি বস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজাদ অল ইন্ডিয়া খিলাফত কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। আজাদের নিজস্ব জীবনেও পরিবর্তন আসে। ড. মুখতার আহমেদ খান, হাকিম আজমল খান ও অন্য খিলাফত নেতাদের সঙ্গে তিনিও মহাত্মা গান্ধীর নৈকট্যে আসেন ও তাঁর অহিংস দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তিনি চরকায় কাটা সুতোর খাদি বস্ত্র পরিধান করতেন, প্রায়ই গান্ধীর আশ্রমে যেতেন। আবার তিনি হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর অনুসৃত খুবই সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। আজাদ ক্রমশ অন্যান্য জাতীয়বাদী নেতা যেমন জওহরলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাস চন্দ্র বোসের সংস্পর্শে আসেন ও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতাত্তোর ভূমিকা: দেশ ভাগের ফলে দাঙ্গাহাঙ্গামার উদ্ভব হলে মাওলানা আজাদ বিপদে পড়া মুসলমানদের নিরাপত্তা ও আশ্বাস দিতে বাংলা, বিহার ও পাঞ্জাবের বর্ডার এলাকাগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি রিফিউজি ক্যাম্প তৈরির ব্যাপারে সহায়তা করেন ও সেখানে খাদ্য, পানীয় ও দরকারি পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করেন। দিল্লি ও পাঞ্জাবের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে ক্যাবিনেট মিটিংয়ে সর্দার বল্লব ভাই প্যাটেলের সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি হয়। তাঁর অবদানের কথা বেশি না বললেও চলে। তিনি ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। ভারতের সংবিধান প্রস্তুতের জন্য যে কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলি হয়েছিল, তিনি তার একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁর মন্ত্রিত্বে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি এডুকেশনের সংশোধন ও উন্নয়ন, বিজ্ঞানের ব্যাপক শিক্ষা, নানা বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চতর ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়। তিনি ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন, কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস, সাহিত্য অ্যাকাডেমি, সংগীত–নাটক অ্যাকাডেমি, ললিতকলা অ্যাকাডেমি ইত্যাদি বিভাগ চালু করেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মানসম্মত শিক্ষাপ্রণয়নের জন্য কতকগুলো আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) প্রতিষ্ঠা করেন।
কংগ্রেস ও আজাদ: মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর অসহযোগ আন্দোলন সহায়তা করার প্রাক্কালে ১৯২০ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) যোগ দেন। ১৯২৩ সালে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। তিনি মতিলাল নেহরুর রিপোর্ট অনুমোদন করেছিলেন, যদিও অন্যান্য মুসলিম স্বাধীনতাসংগ্রামী নেতারা এর বিরোধিতা করেছিলেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আইনের আওতায় তাঁকে মিরাট কারাগারে দেড় বছরের জন্য আটক রাখা হয়।
মৃত্যু: ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান পুরোধা ব্যক্তিদের একজন মহান আত্মা, মহাবিদ্বান, অমূল্য অবদানকারী এই মহান নেতা ১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তাঁকে দিল্লির জামে মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। জাতির প্রতি তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য মৃত্যুর পরে ১৯৯২ সালে তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ পদক ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
স্মরণীয়: মাওলানা আজাদ হিন্দু–মুসলিম সহাবস্থানে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর কল্পনা ছিল এক অভিন্ন ভারত, যেখানে সব ধর্মের মানুষ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে। তিনি ভারত ভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন। অন্যান্য খিলাফত আন্দোলনকারী বন্ধুদের সহযোগিতায় তিনি দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ভারতের একটি ‘প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি’ হিসেবে গড়ে উঠেছে। তাঁর সম্মানার্থে ১১ নভেম্বর তাঁর জন্মদিনটি সারা ভারতবর্ষে ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।