https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/fd6f064a20a2c7c661cf5f48ff18dda6-5de0fb76601f7.gif
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

অভিশংসন তদন্ত শুনানিতে আসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?

by

থ্যাংকসগিভিং ডের ছুটি চলছে এখন আমেরিকায়। এই ছুটিতে পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকাই দস্তুর। কিন্তু এবার মনে হয় তেমনটি আর হচ্ছে না। কারণ, ছুটির আমেজে ভাগ বসাতে উপস্থিত হয়েছে রাজনীতি। এমনিতে গড় আমেরিকানরা রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না। কিন্তু চলমান অভিশংসন তদন্ত চিত্রটি বদলে দিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের করা জরিপের তথ্য বলছে, অন্তত ৪০ শতাংশ
আমেরিকান গভীর দৃষ্টি রেখেছেন এ তদন্তের দিকে। আরও ভালো করে বললে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে। মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ব্যক্তি স্বার্থে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন কিনা, যা সম্প্রতি নৌমন্ত্রীকে বরখাস্তের মধ্য দিয়ে আর জোরালো হয়ে উঠেছে।

গড়পড়তা আমেরিকানদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে অত উত্তেজনা নেই। যতটা যা দেখা যায়, তাও ওই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে। কিন্তু চলমান অভিশংসন তদন্ত মোটাদাগে সবাইকে রাজনীতির প্রতি মনোযোগী করে তুলেছে। থ্যাংকসগিভিং ডের টার্কি খেতে খেতে অন্তত ৪০ শতাংশ আমেরিকান এ তদন্তের চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্য নজর রাখবেন। আর প্রায় সব আমেরিকানেরই এ তদন্ত নিয়ে নিজস্ব অভিমত রয়েছে। এও উঠে এসেছে সিএনএনের জরিপেই। এই অংশটির দৃষ্টি অবশ্য ট্রাম্পের করা ন্যায়-অন্যায়ের দিকে নয়। তাদের প্রশ্নটি হলো, ‘ট্রাম্প কি অভিশংসিত হচ্ছেন?’
এখন পর্যন্ত তদন্ত যতটা এগিয়েছে, তাতে ট্রাম্প অভিশংসিত হবেন কিনা, তা বলার কোনো সুযোগ নেই। আর অভিশংসন মানেই কিন্তু ওভাল অফিস থেকে অপসারণ নয়। এটা স্পষ্ট, প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডেমোক্র্যাটরা নিম্নকক্ষে অভিশংসনের প্রস্তাব পাস করাতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসী। তদন্তের প্রতিবেদনটি হাতে এলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। নিম্নকক্ষে প্রস্তাবটি পাস হলে ট্রাম্প হবেন আমেরিকার ইতিহাসের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি এই অসম্মানজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবেন। সর্বশেষ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন বিল ক্লিনটন ১৯৯৮ সালে। অন্যটি ১৮৬৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। রিচার্ড নিক্সনকে এমন পরিস্থিতির মুখে আক্ষরিক অর্থে পড়তে হয়নি, আগেভাগেই পদত্যাগ করায়। ট্রাম্প এখনো অনুরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়েননি। তবে পড়লে, তিনি একে কতটা ‘অসম্মানজনক’ বিবেচনা করবেন, তা ভাবনার দাবি রাখে।
অভিশংসন প্রস্তাব প্রতিনিধি পরিষদে ওঠার আগে বহু কাজ বাকি রয়েছে। অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রস্তাব বড়দিনের আগেই উত্থাপন করা হতে পারে বলে ডেমোক্রেটিক দলের কয়েকটি সূত্র বলেছে। দুই সপ্তাহে মোট পাঁচ দিন শুনানি গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট তদন্ত দল এখন প্রতিবেদন তৈরির কাজটি করছে। থ্যাংকসগিভিং ডের এই ছুটি তাদের জন্য ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ধন্যবাদ জ্ঞাপনের যে ঐতিহ্যকে স্মরণ করতে এ উৎসব, তার পুরো সময়টি তাঁরা কাজে লাগাবেন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অভিযোগ দাঁড় করাতে। এদিকে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটি এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তারা শুনানি শুরু করবে। ভোটের জন্য অভিশংসন প্রস্তাব প্রতিনিধি পরিষদে উঠতে এ শুনানিকে উপসংহারে পৌঁছাতে হবে।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া সাক্ষ্য বলছে ডেমোক্রেটিক দলের পক্ষে বেশ শক্ত একটি প্রতিবেদনই দাখিল করা সম্ভব, যার ওপর দাঁড়িয়ে তারা প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসন প্রস্তাব পাস করিয়ে নিতে পারবে। কারণ, নিম্নকক্ষে ডেমোক্র্যাটরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ ক্ষেত্রে তাঁরা অন্তত একজন রিপাবলিকানকে পাশে পাবেন। তিনি হলেন মিশিগান থেকে রিপাবলিকান দলের হয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি জাস্টিন অ্যামাশ। ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত এই নেতা চলতি বছরের শুরুর দিকে রিপাবলিকান দল ত্যাগ করেন। তবে ডেমোক্র্যাটরাও তাঁদের ১৮ জন সদস্যকে বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিতে দেখতে পারেন। প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাব পাসে এটি বড় ব্যবধান না গড়লেও, সিনেটে প্রস্তাব পাসে এটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দেবে। কারণ সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৬৭টি ভোট নিয়ে প্রস্তাবটি পাস করতে হলে, রিপাবলিকান দলের অন্তত ২০ জন সদস্যকে নিজ দলের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে। এ হিসাবে দাঁড়িয়ে ডেমোক্র্যাটদের রণেভঙ্গ দেওয়াই উচিত। কিন্তু তাতে বাধ সাধছে, খোদ সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককোনেল। প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের পক্ষে প্রস্তাব পাস হলে তিনি ‘বিচারকাজ’ শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আমেরিকার ইতিহাস বলে অভিশংসনের মুখে পড়লেও কোনো প্রেসিডেন্টকে ওভাল অফিস থেকে অপসারিত হতে হয়নি। তাহলে ডেমোক্র্যাটরা কেন এত শ্রম দিচ্ছেন? কেনই বা এত তোড়জোড়? উত্তর হচ্ছে চিরকালীন ভোটারদের পাশে রাখা। ডেমোক্রেটিক দলের ভিতটি শহরাঞ্চলেই শক্ত। আর এই ভোটারদের অভিশংসন তদন্তের প্রতি সমর্থন রয়েছে। মাঝপথে হাল ছেড়ে দিলে, এসব ভোটারকে হারাতে হতে পারে। প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রস্তাবটি পাস হলে আগামী নভেম্বরের আগে ভোটারদের সামনে নিজেদের মান রক্ষার একটা কিছু হাতে থাকবে তাদের। গ্রামাঞ্চলে রিপাবলিকান শিবিরে একটা বিভক্তি তৈরি হওয়াও এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ, যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জবাবদিহির জায়গাটি দেখিয়ে দেওয়া বলে এমনকি রিপাবলিকানরাও মনে করেন।
শেষোক্ত বিবেচনা থেকে ডেমোক্র্যাটরা এমনকি মার্কিন সামরিক বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদেরও পাশে পেতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে সরব কোনো সমর্থনের আশা করার সুযোগ তাঁদের নেই। তবে নীরব সমর্থন যে থাকবে, তা একরকম নিশ্চিত। কারণ দুটি; এক. ইউক্রেন এবং দুই. সামরিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ। ইউক্রেন আমেরিকার শুধু নয়, পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তা কৌশল ও পররাষ্ট্রনীতির জায়গা থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। কারণ, এ দেশটিই রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে দেয়াল হিসেবে কাজ করে। তাই এই দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখাটা আমেরিকার কাছে যেকোনো মূল্যে অগ্রাধিকারভুক্ত। কিন্তু এই ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত সামরিক সহায়তা তহবিলটি দেওয়ার শর্ত হিসেবে ট্রাম্প ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি আমেরিকাসহ পুরো পশ্চিমের নিরাপত্তা প্রশ্নে একটি হতবুদ্ধিকর পদক্ষেপ।
ট্রাম্প এমন অবস্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিকেই জলাঞ্জলি দিতে বসেছেন, যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর সামরিক বাহিনীকে চটানোর কাজটি তিনি মাত্র কয়েক দিন আগে করেছেন নৌমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে। আর এটি তিনি করেছেন একজন যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচাতে গিয়ে। বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছেন না সেনা কর্মকর্তারা। তাঁদের দৃষ্টিতে এটি সামরিক খাতে বিভাজন সৃষ্টির শামিল। এটি পুরো সামরিক বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে, যা ট্রাম্প বা রিপাবলিকান দলের জন্য ইতিবাচক নয়।
সব মিলিয়ে ট্রাম্পের সামনে শুধু অভিশংসন তদন্তই নয়, আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যদিও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রেসিডেন্ট বলেই চলেছেন, ‘সবাই মিথ্যাবাদী’। যিনি অভিযোগ তুলেছেন, যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, আর যারা তদন্ত করছেন, সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র লিপ্ত। এ অবস্থায় ডেমোক্রেটিক দলের পক্ষ থেকে অভিশংসন তদন্ত দল প্রেসিডেন্টকে শুনানিতে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সময় এক সপ্তাহ। তাঁদের বক্তব্য, ট্রাম্প সে প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে এসে নিজেই অভিযোগগুলো তুলুন, নয় তো বাইরে থেকে মন্তব্য করা বন্ধ করুন। ট্রাম্প এখনো এ প্রস্তাবে সাড়া দেননি। তবে তাঁর চিরাচরিত ‘বড় গলায়’ একটু আগল দেওয়া গেছে। তিনি বেশ বিপাকেই পড়েছেন বলা যায়। অন্তত, তাঁর আপাত চুপ হওয়া তা-ই বলে। এটি কত দিন থাকে, আর এই তদন্তের ফলই বা কী হয়, তা দেখতে এখনো অনেক বাকি। আপাতত থ্যাংকসগিভিংয়ের ছুটিতে টার্কি খেতে খেতে তর্ক জমুক। হোক জল্পনা। আর ডেমোক্র্যাটরা ব্যস্ত থাকুন শক্ত অভিযোগসহ প্রতিবেদন তৈরিতে।