‘ক’ অক্ষর শিখতে...
by ইশতিয়াক রূপু১৯৯৪ সালের নভেম্বরে লন্ডনের এক শীতের সকাল। দিনটি শুরু হলো বিদেশের মাটিতে প্রথম কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার ব্যস্ততা নিয়ে। শৈশবের এক বন্ধুর টেলিফোনে সব পরিকল্পনার আমূল পরিবর্তন। যাওয়ার কথা ছিল ব্রিটেনের ওয়েস্ট সাসেক্স এলাকার ওয়ার্দিং শহরে। বন্ধুর শক্ত গালির সঙ্গে মৃদু ধমক হজম করে রওনা দিলাম সাউথ ওয়েস্ট এলাকার সমুদ্রতট ঘেঁষা ছোট্ট শহর পেইংটন অভিমুখে। বাহন ব্রিটেনের দ্রুতগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, যা ব্রিটিশ রেলের গর্ব বলে তখন যেমন, আজও তেমন বিবেচিত হয়। দীর্ঘ যাত্রা শেষে শীতের এক বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে দেখা প্রায় ১৫ বছর পর। গভীর রাত অবধি আড্ডা হলো। অনেক সময় নিয়ে জানা গেল বন্ধুর এত দিন যাবৎ না–জানা অনেক খবর। সামান্য বিরতি পেয়ে বন্ধুকে জানালাম হঠাৎ করে বিদেশ চলে আসার আসল কারণ। নীরবে মনযোগ দিয়ে বন্ধু সবই শুনল। মধ্য রাত অবধি আলাপের শেষ কথা ছিল জীবনযুদ্ধের সম্মুখে তো কখনো আসিসনি। এবার যখন আসতেই হলো, তৈরি হয়ে যা যুদ্ধের জন্য। আমি আছি তোর সঙ্গে। তোর যেকোনো প্রয়োজনে যতটুকু পারি সহায়তা করবই।
ছোট শহরে বন্ধুর টেকওয়েতে বিক্রি হয় মজাদার ভারতীয় খাবার। তৈরি করেন খাঁটি বাংলাদেশিরা। নিজস্ব মালিকানায় ডুপলেক্স বাড়িও আছে একখানা। সেখানে রাজকীয় স্টাইলে পালে দুটি দামি কুকুর। দুটি কুকুরের নাম প্রথমবারের মত শুনলাম, একটির নাম হাছা অন্যটি মিছা। মানে হাছা ও মিছা। একটি রুথ ভায়লার জাতের অন্যটি জার্মান শেফার্ড। ওদের দেখা শোনা করত ফ্রান্স থেকে আসা সিজনাল কুকুরের সেবাদানকারী। দুটিকে দেখভালের জন্য ভালো অঙ্কের পাউন্ড খরচ করত বন্ধুটি। লন্ডন ছেড়ে বন্ধুর শহর পেয়িংটন আসার দিন বিকেলে ট্রেন স্টেশনে নেমে ছেলেবেলায় দেখা বন্ধুকে পেলাম না। সময় নিয়ে ডানে–বাঁয়ে ভালো করে তাকিয়ে চিনতে হলো। অবাক চোখে যাকে দেখলাম, প্রথম দর্শনে তাকে চেনা কষ্টকর বৈকি। মাথার পেছনে লম্বা চুলের পনিটেল ঝোলানো মধ্যবয়স্ক কাউকে দেখে বন্ধু ভাবা সহজ ছিল না। আরও অবাক হলাম, যখন সে দুহাতে ধরে আছে ওর প্রিয় দুটো পালিত কুকুর হাছা ও মিছাকে। ট্রেন থেকে নেমে সোজা তার বাড়ি। দুপুরের খাবার পাবদা মাছের পাতলা ঝোলের তরকারির সঙ্গে সাদা ভাত।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দোস্ত তুমি তো জানো আমি কুকুর ভয় পাই। সে অভয় দিয়ে বলল, ওরা হাছা ও মিছা (পোষা কুকুর দুটো) কালো লোকদের ভয় দেখায় না। ভয় দেখায় শুধু সাদা চামড়ার ইংরেজদের। বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে গেলাম টেকওয়েতে। কিচেনের দায়িত্বে বন্ধু নিজে। সামনে কাস্টমারদের সামলাত এক ইংলিশ তরুণী। সিদ্ধান্ত হলো সপ্তাহ খানিক তার সঙ্গে থেকে কিছু কাজ শিখে পরে আশপাশের কোনো রেস্টুরেন্টে যোগ দেব। রাতে বাসায় ফিরে দেখি, বাসায় নতুন অতিথি। ইউরোপিয়ান সাজসজ্জা, তবে চেহারা দেখে মনে হলো বাঙালি। এক পলক দেখেই মনে হলো বড্ড চেনা–জানা। কোথাও দেখেছি। সেই মুহূর্তে মনে আসছিল না এবং চিনতে পারছিলাম না, তিনি কে?
বন্ধু আগেই বলে রেখেছিল, বাসায় কাউকে দেখলে বেশি কৌতূহলী না হতে। যা দেখবি সহজভাবে নিবি। নিজের সব কৌতূহল নিজের কাছে রেখে দিলাম। তবুও বারবার মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছি ওই ভদ্রমহিলাকে। সারা দিন কাজ আর ঘোরাঘুরি শেষে বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরা হলো অতিথিসহ একসঙ্গে। নিচে চলল খানিক হালকা আড্ডা। আড্ডা তেমন জমে উঠল না অতিথি আর বন্ধুর তাড়ার কারণে। ঘুমানোর আগে দুজনে আবার বাইরে বের হলাম হাছা ও মিছাকে নিয়ে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। এরই মধ্যে বাসার পাশের পার্কে আমি আর বন্ধু ঘণ্টা খানিক কাটালাম হাছা–মিছাদের নিয়ে। বৃষ্টি মাথায় বাসায় ফিরে দেখি, বাঙালি চেহারার নারী অতিথি ওপরে দুটি বেডরুমের একটিতে শুতে চলে গেছেন। অন্যটিতে বন্ধু আমাকে ঘুমাতে বলল। সঙ্গে বলে দিল, এটি তোর শোয়ার ঘর। যত দিন থাকবি এই রুমে শুতে পারবি।
জিজ্ঞেস করলাম, তুই থাকবি কোথায়? পাশের রুমটি তো তোর অতিথিকে থাকতে দিলি। উত্তরে জানাল, সে হাছা–মিছাদের নিয়ে বৈঠকখানায় শুতে যাবে। মিনিট দশেক পর আমি সোজা বিছানায়। ক্লান্তিতে একেবারে আলু–পটল অবস্থা। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে চোখে দুনিয়ার ঘুম। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল বাথরুমে যাব বলে। দরজা খুলে বাথরুমে সেরে ভাবলাম, বন্ধুকে দেখে আসি। সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নেমে দেখি, লম্বা গোলাকার সোফাতে শুধু হাছা ও মিছা। সিঁড়ির মুখে আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ওরা বারবার আমাকে দেখছে। কিছুটা ভয় লাগছে আমার। একা নিচে নেমে ওদের পাশে বসতে সাহস পাচ্ছি না বন্ধুকে ছাড়া।
বাড়ির ওপরতলায় দুই বেড রুমে দুই অতিথি। যার একজন আমি। পাশের রুমে অন্য জন। যাকে দেখেই মনে হয়েছিল, আমি চিনি বা জানি তাঁকে। কিন্তু সব যেন অদলবদল লাগছে। তাই ধরতে পারছি না। তবে এটি নিশ্চিত, অতিথি শুধু আমার নয় অনেকেরই চেনা–জানা। তা হলে বন্ধুটি কোথায় গেল? নিচে নেই অথবা হাছা–মিছাকে নিয়ে বাইরেও যায়নি। তাহলে কই গেলিরে বাছা? ভাবতে ভাবতে বিছানায় আবার ফেরত আসলাম। সকালে ঘুম ভাঙল বন্ধুর তাড়ায়। সকাল সকাল ওকে দেখে মনে হলো, সে খুব তাড়ায় আছে এবং সঙ্গে অনেক উৎকণ্ঠা। বারবার ওপর নিচ করছে। কখনো বাইরে যাচ্ছে, আবার ঘরে ফিরে ফোনে নিচু স্বরে কার সঙ্গে আলাপ করছে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে। আমাকে দেখে বলল, দোস্ত তুই এক কাজ কর। তাড়াতাড়ি এখনই টেকওয়েতে চলে যা, আমি আসছি।
জিজ্ঞেস করতে যাব, কি ব্যাপার? তুই এত টেনশনে কেন? তা বলার আগেই বলে উঠল। এখন যা বলছি শুন। আমি এসে, সব খুলে বলছি।
ঘণ্টা চারেক পর বন্ধুটি বিধ্বস্ত অবস্থায় টেকওয়েতে এসে ধপাস করে বসে যা বলল, তা শুনে আমার চোখ কপালে। তখনই মনে হলো, তাইতো বলি এত পরিচিত মুখকে না চেনার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত নানা ঝামেলায় ছিলাম বলেই তখন মাথা কাজ করেনি। এখন সব জেনে মনে হলো, আমি চিনি গো চিনি তোমারে! ওগো ঝগড়াবাদিনী! তুমি তো সেই তথাকথিত স্পষ্টবাসিনী। যিনি শতাধিক তরুণ, প্রৌঢ়, মধ্যবয়স্ক, কবি লেখকদের একেবারে খোলামেলা করে দিয়েছিলেন। কাউকে সম্মান বাঁচাতে আদালতের শরণাপন্ন পর্যন্ত হতে হয়েছিল। তোমার মূল দর্শন তো তাই ছিল। সব উজাড় করে দাও। তুমি তো সদা তাই বলতে এবং বিশ্বাসও করতে। চেনা তো হলো, জানা তো হলো। শুধু জানা হলো না দুটি বিষয়। সকালে বন্ধু এত টেনশনে ছিল কেন? আর দ্বিতীয় বিষয় পরে আসছে।
ভোর রাতে লন্ডন থেকে বন্ধুর কাছে একটি টেলিফোন আসল। সারমর্ম ছিল, তার বাসায় ইসলামের একজন শত্রু আশ্রয় নিয়েছে। ইসলামি হুকুমত কায়েমের কয়েকজন আসছেন, তাঁকে কতল করতে। যা শুনে আমার বন্ধু বিনা আঘাতে কতল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। তাই তড়িঘড়ি করে সেই মেহমানকে প্রায় জোর করে অজানা এক শহরে চালান দিয়ে আসল। যিনি এসেছিলেন ইউরোপের অন্য এক শহর থেকে।
অবশ্য বন্ধুর অনেকটা আন্দাজে ছিল। বলাতে বিষয়টি পরিষ্কার হলো। বললাম, সকালে টেনশন ছিল বন্ধু, তা মেনে নিলাম। রাতের বিষয় এবার খোলাসা করে বলো। বন্ধু উত্তরে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, তুই তো জানিস পড়াশোনাতে আমি একটু কাঁচা ছিলাম। বিশেষ করে বাংলা ভাষায়। শুনলাম অতিথি নাকি বাংলা ভাষার একজন নামকরা কবি। তাই ভাবলাম আর কিছু না পারি, দু–চারটে অক্ষর শিখে রাখি। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। তাই ওনার কাছে শিখতে গিয়ে ছিলাম বাংলা ভাষার প্রথম অক্ষর। নাম ‘ক’।