https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/f2c04b1804768a816658aa0822fd72fd-5de0f26e0950c.gif
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ইতিহাসের জবানবন্দি

by

১৯৭০ সালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। আমাদের হাইস্কুলের পাশে খেলার মাঠে বিশাল স্টেজের পেছনে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ গাভির ছবিসহ এমন একটি পোস্টার লাগানো হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এই গাভিটির সবটুকু দুধ পাইপ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বঞ্চনার নিদর্শনের প্রতীক। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের সেই অসম্ভব শক্তিশালী পোস্টারটি এখনো চোখে ভাসে। তখন আমি হাইস্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকাটাই পছন্দ করতেন। তিনিও এ ব্যাপারে তেমন বেশি কথা বলতেন না। মনে হয়, রাজনীতি নিয়ে বাবার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।
প্রথমবারের মতো বাবাকে দেখলাম এই বিশাল সমাবেশে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। শুধু বাবা নন, মফস্বল শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মাঝে সাজ সাজ রব পড়ে গেল এই সমাবেশ নিয়ে। সেদিন আমাদের বাসার সামনে দিয়ে মানুষের ঢল দেখলাম। সবার গন্তব্য একই জায়গায়। শুধু ঈদের দিন সকালবেলা বাসার সামনে দিয়ে মানুষের এমন ঢল দেখেছি জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে।
আমাদের বাসার কাছে চৌরাস্তার মোড়ে সন্ধ্যায় প্রায়ই দুটি ছাত্রসংগঠনের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার চিৎকার শুনতাম। কলেজ ছাত্রাবাস খুব কাছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একেবারে মাঝখানে আমাদের বাসা। পুরোনো কলেজ প্রাঙ্গণে মিটিং-মিছিল শেষে ফিরতি পথে সম্ভবত তাদের শক্তির এই মহড়া আমাদের ভয় পাইয়ে দিত। তবে কেউ কখনো মারাত্মক আহত হয়েছেন বলে শুনিনি। কলেজ থেকে ফেরার পথে দুই গ্রুপ ছাত্রের এমন তৎপরতা খুব স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)—এই দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া লেগেই থাকত। অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন এদের শক্তির ধারে-কাছেও ছিল না। বছরজুড়ে শহরের পুরোনো কলেজের মোড়ে এদের কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীদের মিটিং লেগেই থাকত। যেন তারাই শোষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার একেবারে দ্বারপ্রান্তে।
একদিন বাসার সামনে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক নেতাদের আগমন বেড়ে গেল। ঠিক আমাদের বাসার বিপরীতে বিশাল গেটের ভেতর দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর বাসায় দলে দলে লোক ঢুকছিল। তিন তিনবারের নির্বাচিত পৌরসভার চেয়ারম্যান তিনি। শহরের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমার কাছে শহরে ওবায়দুর রাজার সমকক্ষ বলে কাউকে কখনো মনে হয়নি। গুরুগম্ভীর, মেপে মেপে কথা বলতেন। অপ্রয়োজনীয় কথা একদম বলতেন না। ওনার সামনে দিয়ে যেতেও চুপসে যেতাম। শুধু আব্বার সঙ্গে জুমার নামাজে যাওয়ার সময় কখনো ওনার পেছনে থেকেছি, যখন আব্বা আর উনি কথা বলতে বলতে জামে মসজিদের দিকে এগিয়ে যেতেন। তাদের গুরুগম্ভীর কথাবার্তা শুনে মনে হতো, এমন ব্যক্তিত্ববান সফল মানুষ হতে পারলে জীবনে আর কিছু লাগবে না। শহরের সবকিছুর ভারসাম্য যেন দেওয়ান ওবায়দুর রাজার বাড়ি ঘিরে। এসডিও, এসডিপিওসহ প্রশাসনের সব পদস্থ কর্মকর্তাদের আনাগোনা লেগেই থাকত দেয়াল ঘেরা এই বিশাল বাড়িতে।
মফস্বল শহরের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেল। দেওয়ান সাহেব আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। তারই সমর্থনে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন বক্তৃতা দিতে। খাবারদাবার, বিশ্রাম—সবকিছু ওবায়দুর রাজার বাড়িতেই হবে। সুতরাং সিংহ পুরুষ শেখ মুজিবকে সহজে দেখার সুযোগ এসে যায়। শেখ মুজিব সম্বন্ধে আগে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। শুধু জেনেছিলাম, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি।
দলে দলে শহর ও গ্রামের সাধারণ মানুষ সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ। ওবায়দুর রাজা চৌধুরীর বাড়ির অন্য প্রান্তে পাশাপাশি পিডিপির ডাকসাইটে কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদ আলীর বাড়ি। মিনিস্টার বাড়ি নামে সবাই চিনে। আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী মাহমুদ আলী। সত্তরের নির্বাচন। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে যাচ্ছিল নির্বাচনী গান আর প্রচারণায়। ‘ওরে মুজিব, বাইয়া চল’ অসাধারণ সব গান মধ্যে রাত পর্যন্ত বাজতে থাকত। দুই পক্ষের মাইকের আওয়াজ এত তীব্র ও তীক্ষ্ণ ছিল যে, রাতে ঠিকমতো পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া যেত না। তবু কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা সংঘর্ষ হতো না। সে এক অসাধারণ পরিবেশ।
মুজিব আসবেন শহরে। আগে কোনো দিন সুনামগঞ্জ শহরে এসেছিলেন কিনা, আমার জানা নেই। শহরে এত বড় বিশাল সমাবেশের আয়োজন হয়েছে কিনা, তাও মনে নেই। মাঝে মাঝে শহরে প্যান্ডেল টাঙিয়ে বিরাট ওয়াজ মাহফিল হতো, কিন্তু এত লোকের অংশগ্রহণ কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। সমাবেশের দিন আমাদের স্কুল আগেই ছুটি হয়ে যায়। আমার বন্ধু শাহিনকে নিয়ে আগেই মাঠে পৌঁছালাম। তখনো শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি, কিন্তু তাকে নিয়ে অসাধারণ সব গান রচনা হয়ে গেছে। মুজিব মঞ্চে আসার আগ পর্যন্ত গান হচ্ছিল। বাউল শাহ আবদুল করিম দরদি গলায় খুব অর্থবহ কী একটা গান গাইলেন, এখন মনে পড়ছে না।
আমাদের বাসার ঠিক বিপরীতে দেওয়ান ওবায়দুর রাজার বাসায় দুপুরের খাবারের পর শেখ মুজিব সমাবেশ আসবেন, তাই মনে হলো। কিছুক্ষণ আগে দেখেছিলাম, শেখ মুজিবের গাড়ির বহর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ওবায়দুর রাজার বাসায় ঢুকছিল। সাদা ধবধবে পায়জামা পাঞ্জাবি পরা ইতিহাসের এক মহানায়ককে অত্যন্ত কাছ থেকে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিলাম। খোলা জিপে যাচ্ছিলেন আর হাসিমুখে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছিলেন পাশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। হাতে পাইপ।
সামান্য বিশ্রামের পর শেখ মুজিব এটিম ফিল্ডের এই বিরাট সমাবেশে আসলেন। সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উঠে বসে পড়লেন। আমাদের শহরের সবচেয়ে বড় মাঠটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে গেল। কোথাও কোন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। চতুর্দিকে রাস্তায়ও মানুষের জায়গা হচ্ছে না। কেউ ছাদে, মেথর পট্টির উঠানে, বার লাইব্রেরির কোনায়, কোর্টের বারান্দায় অথবা গাছের ডালে। অবাক হয়ে দেখছিলাম কোটি মানুষের হৃদয়ের মহানায়ককে। পিনপতন নীরবতা। মহান এই নেতা মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। অবহেলিত ভাটি অঞ্চলের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে গেলেন। সিলেট হয়ে আসতে কত ভোগান্তি হয়েছে প্রকাশ করলেন। বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, জেল-জুলুম হুলিয়া কোনোভাবেই বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
পেছনের পোস্টারের ইঙ্গিত করে শেখ মুজিব বললেন, ‘আমরা সোনালি আঁশ বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি পশ্চিমারা সব নিয়ে যায়। আমাদের রাস্তাঘাট নৌবন্দর অবহেলিত। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ সবকিছুর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনীতে আনুপাতিক হারে বাঙালির নিয়োগ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালিরা সমানুপাতিক হারে চাকরি পাচ্ছে না। এই অবস্থা চলবে না। সম্ভবত উল্লেখ করেছিলেন, প্রতিরক্ষা, মুদ্রা ও পররাষ্ট্রনীতি বাদে সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকবে প্রাদেশিক সরকারের। পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে নতুবা ওয়ালাইকুম সালাম। একের পর এক কথার ফুলঝুরি, যেন বক্তৃতার জাদুকর ছন্দের তালে তালে মহাকাব্য মুখস্থ বলে যাচ্ছেন। সবাই তন্ময় হয়ে শুনছি। কখন যে ঘণ্টা চলে যাচ্ছিল, আমরা বুঝতেই পারিনি। অবশেষে শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন, ‘আমি যদি কলাগাছও নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করাই, আপনারা তাকে ভোট দেবেন’।
আমি বিস্ময়ে হতবাক, শেষ পর্যন্ত আমাদের দেওয়ান সাহেবকে তিনি কলাগাছের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনলেন! সেদিনই মনে হয়েছিল আকাশ ছোঁয়া এই ব্যক্তিত্বের কাছে সবাই কলাগাছ। তিনি তালগাছ, যিনি অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাংলার মানুষ তাঁর কথা শুনেছিল। ছয় সাত আসন বাদে সব আসন আওয়ামী লীগ পায়। অর্থাৎ মুজিব যা বলেছিলেন তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন বাংলার জনগণ জানিয়েছে। আপামর জনসাধারণের সে এক মহাবিজয়। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক বিশ্বাসঘাতকতা করে নিরীহ মানুষের ওপর রাতের অন্ধকারে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালালে বাংলার মানুষ গর্জে উঠে। লাখ লাখ প্রাণ ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা নেতার জন্ম না হলে বাংলা কোনো দিন স্বাধীন হতো না।
পরের ইতিহাস আরও মর্মান্তিক ও ভয়াবহ। আইনশৃঙ্খলার অবনতির সুযোগে নিজের দলের কিছু বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। সঙ্গে পথভ্রষ্ট কিছু সামরিক কর্মকর্তা। দুই মেয়ে বাদে পরিবারের সবাই ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরে দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ চার নেতাকেও জেলের ভেতর কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়, যাতে দেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই তাই ঘটে। এই মহান নেতাকে এবং যাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তীতে দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন, শ্রদ্ধাভরে তাদের কৃতজ্ঞ চিত্তে জাতিকে স্মরণ করতে হবে।
সেই শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। এই শহীদরা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। সব ভুলভ্রান্তি ও ভেদাভেদ দূরে সরিয়ে এখন একতাবদ্ধ হয়ে এই বাংলা গড়তে হবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে। কোনো বানোয়াট অজুহাতে কাউকে নিগৃহীত হতে দেওয়া যাবে না অথবা কেউ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবে না। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। ধাপ্পাবাজি ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত কোনো দালালকে ছাড় দেওয়া যাবে না। দলমত-নির্বিশেষে সব অপরাধী ও মুনাফাখোরের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই বাংলায় কোনো দল বা পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। বিচার বিভাগ এখানে অন্ধ হয়ে যাবে। আইনের চোখে সবাই সমান, সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এই স্বপ্নের সঙ্গে কখনো আপস হতে পারে না। এর ব্যত্যয় মানেই ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হওয়া এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। এই দেশ আমার সোনার বাংলা।