https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/9cac493c590c33481f979e86277f3996-5de0f788e4f11.gif

রং–তুলিতে শুক্লার মুক্তিযুদ্ধ

by

আসছে ডিসেম্বর মাস। আমদের বিজয় ছিনিয়ে আনার মাস। বাংলাদেশ। যেন সত্যিকারের এক শিশু। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় বাংলাদেশ। নয় মাস দশ দিন পর যেমন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, এই দেশটিও তাই। তবে এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে ছাত্র, শিক্ষক, আপামর জনসাধারণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রং–তুলির কারিগর তাঁর তুলি–রং ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন স্টেনগান। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
শিল্পী সুনীল শুক্লার জন্ম সুনামগঞ্জে ১৯৫৩ সালে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যাদের জন্ম, তিনি তাদের দলে নন। লক্ষ্য স্থির রেখে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আজ তিনি একজন সার্থক মানুষ। ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করেছেন ১৯৭৭ সালে। ভালোবেসে বিয়ে করেন সুনামগঞ্জের মেয়ে কবি তৃষ্ণা শুক্লাকে। বিয়ের পর ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। ডাইভার্সিটি লটারি জিতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড আসেন ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে। মেরিল্যান্ডে আছেন দীর্ঘ ৩০ বছর।
১৯৭৪ সালে সুনামগঞ্জে এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিকেলে চিত্র প্রদর্শনী হয় ও নির্বাচিত আঁকিয়েদের পুরস্কার দেওয়া হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। সে সময় আমি সুনীল শুক্লাকে প্রথম দেখি। দেশকে ভালোবেসে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর কাছে যুদ্ধের গল্প শুনেছি মেরিল্যান্ডে বসে।
সুনামগঞ্জের ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি আর্মি আসার পরপরই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতের বালাট চলে যান বাবা–মাসহ। সেখানে শরণার্থীশিবিরে তরুণদের মধ্যে নৈরাশ্য যখন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনই তাঁর মা তাঁকে বলেন, এর চেয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করো। মায়ের নির্দেশে পরদিনই চলে যান ক্যাম্পে। প্রথম দিন সুনামগঞ্জের ২২ জন নির্বাচিত হন। মীর শওকত আলী ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেলালউদ্দিন। বাঁশতলা হেডকোয়ার্টার। দুটি কোম্পানি। এর একটি নরশিনপুর অন্যটি বালিউড়া। তাঁদের কমান্ডার ছিলেন শামসুদ্দিন। ২২ জনকে তিন গ্রুপে ভাগ করে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। এই ২২ জনের মধ্যে মতিউর রহমান, মালেক পীর, আ ত ম সালেহ, সাধন ভদ্র, মোসাদ্দেক রাজা চৌধুরী, উজির মিয়া, আবু সুফিয়ান, ঝন্টু, শামসুল হক, হিরণ্ময় কর, রথিন—এরা সবাই প্রথম ব্যাচে ছিলেন। ১৯ মে থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
১৯ জুন প্রথম অপারেশন পরিচালনার দিন ছিল। দিনটি ভীষণ উত্তেজনায় কাটে। অপারেশনের স্থান ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পাশের দুরবিন টিলা আর হাদারটিলা। রাত বারোটায় হালকা বৃষ্টির মধ্যে চেলা সীমান্ত দিয়ে ছাতক প্রবেশ করেন। রেকি করার দায়িত্ব একজন আওয়ামী লীগ নেতার ওপর। রাতের অন্ধকারে হেঁটে অস্ত্রসহ যখন তিন মাস পর দেশের মাটিতে পা রাখলেন, তখন ভিন্ন এক অনুভূতি। শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের অনুভূতি বয়ে যায় হিম স্রোতের মতো। গ্রামবাসী যারা ছিল, সবাই উত্তেজনায় তাদের পিছু নিয়েছে। অস্ত্র হাতে তাদের সবাইকে কেউ জলপান করাচ্ছে। কেউ মোরগ জবাই করে খেয়ে যেতে বলছে। যিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ভয়ে কখনো কখনো তাকে পাকিস্তানিদের চর মনে হচ্ছিল। ভয় আর উত্তেজনায় কাঁপছিলেন রীতিমতো। তাঁর হাতে ছিল স্টেনগান। প্রায় ভোরবেলায় গুলি করে সব বাতি নিভিয়ে তারা আবার চেলা সীমান্তে নরশিনপুর ক্যাম্পে ফিরে যান। পরদিন চরমপত্র পড়ার সময় বলা হয়, বিচ্ছুবাহিনী ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে যথাযথ অপারেশন চালিয়েছে গত রাতে।
প্রতিদিনই বিচ্ছু বাহিনীকে হিট অ্যান্ড রান জাতীয় আক্রমণ করতে হতো। তবে তাঁর সঙ্গে উজির মিয়া, সাধন ভদ্র আর রথীনের বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়। গামছা বিছিয়ে মাটিতে সাতজন এক তাঁবুর ভেতর ঘুমান। প্রতি মাসে পঞ্চাশ টাকা মাসোহারা পেতেন। এরপর ১৪ আগস্ট তাদের অপারেশন হয় ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে। ওই দিন তারা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আক্রমণ করেন। কিছুক্ষণ পরপর গুলি করে অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পালন পণ্ড করাই সেদিনের টার্গেট। রাজাকারদের কেউ খবর দেওয়ার পর পাকিস্তানের আর্মিরা তাঁদের অবস্থান মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তাঁদের দলের একজন আহত হন। তবে তাঁদের বিপদ বুঝে হেডকোয়ার্টারে কেউ খবর দেওয়ায় কাউন্টার কভারেজ পাঠানো হলে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তাঁরা ফিরে যান।
শুল্কা আর রথিনকে পুজোর ছুটি দেওয়া হয়। তারা বালাট যান পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। শহীদ নামে রঙ্গারচরের একজন ছিলেন। তিনি সুনীল শুক্লাকে দেখলেই বলতেন, তুমি আর্টিস্ট মানুষ, ছবি আঁকা বাদ দিয়ে স্টেনগান নিয়ে কী করো? শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান ছুটিতে যাওয়ার আগে। শহীদ ভাই তাকে দেখে একটা চিঠি দিয়ে বলেন, ক্যাপ্টেন হেলালের সঙ্গে দেখা করতে। ক্যাপ্টেন হেলালের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, যেহেতু আঁকাআঁকি করেন, তাই তাঁকে হেডকোয়ার্টারে প্রয়োজন হবে। তাকে তিন শ টাকা দিয়ে শিলং থেকে কাগজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনে হেডকোয়ার্টারে যোগ দিতে বলেন। এখানে তাঁর সঙ্গে বজলুল মজিদ খসরু নামে সুনামগঞ্জের আরেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়।
অক্টোবর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় পর্যন্ত সুনীল শুক্লা হেডকোয়ার্টারে কাজ করেন। তাঁকে ম্যাপ এঁকে দিতে হতো। পোস্টার তৈরি করতে হতো। এরপর আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে পারেননি, রথিনসহ অন্য কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। কে বাঁচবে, কে মরবে আর কখনো দেখা হবে কী না, এসব ভেবে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি সঠিকভাবে পালন করতেন। ক্যাপ্টেন হেলালউদ্দিনের সঙ্গে এখনো তাঁর যোগাযোগ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা শহীদের সঙ্গে আবারও যোগাযোগ হয়। ৬ ডিসেম্বরে সুনামগঞ্জ স্বাধীন হয়। আর জানুয়ারির ১২ বা ১৩ তারিখে সুনামগঞ্জ ফিরে আসেন।
যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে শুল্কা এসএসসি পাশ করেন সুনীল শুক্লা। তাঁর দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে আর্কিটেক্ট। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্মরত। ১৮ বছর বয়সে সাইরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয়ে মনুমেন্টের ডিজাইন করে প্রথম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ মেয়ে সুদেষ্ণার করা ডিজাইনের স্মৃতিসৌধ তৈরি হয় কাইন্টডাউন কাউন্টিতে। একজন স্থপতি হিসেবে তার এই কাজে বাবা–মায়ের সঙ্গে সে আমাদের দেশের মুখও উজ্জ্বল করেছেন। সুজয় শুক্লা একমাত্র ছেলে। বর্তমানে ভেরাইজন ওয়ারলেসের করপোরেট অফিসে কাজ করছেন মেরিল্যান্ডে। ছোটমেয়ে বহ্নি দেলাওয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছে। তিনি বর্তমানে নিউজার্সিতে চাকরি করছেন।
ম্যারিল্যান্ডে নিজ বাড়ির বেসমেন্টে সুনীল শুল্কার নিজস্ব জগৎ, শিল্পীর জগৎ। আঁকাআঁকির জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম আর দেয়ালজুড়ে সব শৈল্পিক সৃষ্টি। ক্রমাগত এঁকে চলেছেন। এখন চলছে তার নিরীক্ষাধর্মী আঁকা। অ্যাবস্ট্রাক্ট, প্রকৃতি, ল্যান্ডস্কেপ, নদীতীর, গ্রামের জীবন, জীবনের নানা ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। গত ৩০ বছরে একক ও যৌথ অনেক আর্ট এক্সিবিশন করেছেন।
১৯৭৪ সালে সুনামগঞ্জে নতুন রেস্টহাউসে এক চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। সে সময় প্রথম দেখেছিলাম শুল্কার চিত্রকর্ম সুরমা নদী, নৌকা, মেঘালয় পাহাড়, ঢেকিপাড়, রিকশা, রমণী, মাছ ধরা—এগুলোই ছিল বিষয়বস্তু। এখন অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি আঁকেন বেশি। আগে জল রংয়ে কাজ করতেন বেশি। জল রং আর তেল রঙের কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। উত্তর আমেরিকার ফলের ছবি, ডিসির চেরিব্লসম, ল্যান্ডস্কেপ, হারবার—এগুলো কী জীবন্ত চিত্রপটে আঁকা!
সুনীল শুল্কা খুব মৃদুভাষী। সময় কম থাকায় এবার ছবি নিয়ে অল্প কথা হলো। প্রচারবিমুখ সুনীল শুক্লা ও তাঁর স্ত্রী প্রাণোচ্ছল তৃষ্ণার সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন কামনা করি।