পর্ব ৩৬
জেনারেল নিয়াজীর চোখে জল
by আবদুল্লাহ জাহিদ১৬ ডিসেম্বর। বিকেল ৪:৩১টা, সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। স্থান রেসকোর্স ময়দান। পাকিস্তানি সেনারা অনেক টালবাহানার পর বিনা শর্তে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। একাধিক বিদেশি সাংবাদিক এই সম্পর্কে প্রতিবেদন করছিলেন। সে সব প্রতিবেদনের অংশ বিশেষ নিয়ে এই পর্ব।
ভারতের প্রথিতযশা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার দিল্লি থেকে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর দ্য লন্ডন টাইমস–এ আরেকটি প্রতিবেদন পাঠান, যার শিরোনাম ছিল ‘পার্লামেন্টে মিসেস গান্ধীর আনন্দপূর্ণ বিপুল সংবর্ধনা’ [Parliament’s joyful ovation for Mrs Gandhi]
আজ গ্রিনিচ মান সময় ১১টা ১ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে এবং তিন ঘণ্টা পর ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে।
এটি ছিল অতি নাটকীয়তাপূর্ণ একটি দিন, প্রথমত শেষ সময় পর্যন্ত ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক্সের আহ্বানে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তারপর পূর্ব বাংলার কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর কাছ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়। বুধবার গ্রিনিচ মান সময় ১১টা ৩০ মিনিট থেকে ভারতীয় বোমা আক্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। সর্বশেষে সময় শেষ হওয়ার সামান্য আগে আত্মসমর্পণের বার্তা পাওয়া গেল। ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর (বাংলাদেশের যোদ্ধা) পূর্বাঞ্চলের যৌথ কমান্ডার জেনারেল জে এস অরোরা তাঁর ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনীর সহযোগীসহ হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় যান।
জরুরি ভিত্তিতে ভারতের সংসদের উভয় কক্ষের সভা আহ্বান করা হয়, যেখানে ইন্দিরা গান্ধী পূর্বে আত্মসমর্পণ এবং পশ্চিমে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রথম সংবাদ দেন। সংসদের সদস্যরা তাকে বীরোচিত সাদর অভিনন্দন জানান। সংসদ সদস্যরা সব রেওয়াজ ভেঙে স্লোগান দেন ‘ইন্দিরা, জিন্দাবাদ’। এর ফলে গত দুই দিন যাবত বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির উত্তেজনার অবসান ঘটে এবং সবাই আনন্দে মতোয়ারা হয়ে উঠেন।
চীন ভারতকে সিকিম-চীনা সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে নয়াদিল্লিতে নোট দেয়, যা কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ভারত নিজেও নেফা সীমান্তে চীনের অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের বিষয়টি লক্ষ্য করেছে, ১৯৬২ সালে এই অঞ্চলেই চীনারা ভারত আক্রমণ করে। এ ঘটনায় সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির মাধ্যমে আমেরিকা পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানায়, ব্রিটেন এ ঘটনায় নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি ভারত ও পূর্ব বাংলাকে সমর্থন জানায়।
ঢাকা থেকে দ্য লন্ডন টাইমস–এর পিটার ও’লফলিনের পাঠানো প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানি জেনারেল প্রায় ক্রন্দনরত, রেসকোর্সের অনুষ্ঠানে সাক্ষর করলেন’ [Pakistani general, near to tears, sign at racecourse ceremony]
প্রতিবেদনটি সংক্ষেপে
পশ্চাৎপটে তখনো গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। দিনের আলো কমে আসার মধ্যেই জনতা রেসকোর্স ময়দান ঘিরে দাঁড়িয়েছে। একটি ছোট কাঠের টেবিলের সামনে গোমড়া মুখে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, যিনি আত্মসমর্পণের দলিল সাক্ষর করলেন।
শত শত বাঙালি যারা জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছিল, ভারতীয় বাহিনী তাদের বেষ্টন করে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আত্মসমর্পণের দলিল সাক্ষরের পর নিয়াজীকে যখন হাজার হাজার বাঙালির জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি প্রায় ক্রন্দনরত। ভারতীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরা যিনি মাথায় পাগড়ি পরা একজন শিখ, জনতা ও সৈন্যদের দিকে হাত তুললেন। এর আগে জনতার জয় বাংলা ধ্বনির মধ্য দিয়ে ভারতের দ্বিতীয় প্যারাসুট রেজিমেন্টে ঢাকায় প্রবেশ করে। বাঙালিরা তাদের গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। তারা তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়। তারা পিপাসিত সৈন্যদের জন্য পানি নিয়ে আসে।
এই প্যারাট্রুপার বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মেজর জেনারেল গান্ধারী নাগরা, যার সৈন্যরা স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে ঢাকায় প্রবেশ করে। তিনি সকাল ১০টায় জানতে পারেন, জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করবেন। একজন ভারতীয় অফিসার বি পি হিকে যিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেন, ‘নিয়াজীর কাঁধ থেকে তাঁর পদবি খুলে নেন অরোরা। পাকিস্তান বাহিনী তাদের অস্ত্র নামিয়ে রাখে।’
অনেক বাঙালি যারা রাইফেল ও স্টেনগান বহন করছিল, তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে জড়ো হয়। রেডক্রস এই হোটেলকে নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই হোটেলেই পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর মালিক গত দুই দিন ধরে অবস্থান করছেন। বাঙালিরা শূন্যে গুলি ছুড়তে থাকলে সেখান থাকা কিছু পাকিস্তানি সৈন্য মানুষের ওপর গুলি চালায়। এতে তিনজন নিহত হয় এবং একজন দাঁড়িয়ে থাকা আমেরিকান আহত হয়। ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় কর্নেল পানুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সকালে ঢাকায় প্রবেশ করেন। (চলবে)
লেখক: গল্পকার, কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার
ইমেইল: myshathi@gmail.com