https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/c0d2b32b0b5a59c8a6868dbb752407a9-5de0f1f10cdb0.gif

এই ‘আমি’ সেই ‘আমি’ নয়

by

‘তিন ফোঁটা অশ্রু’—হৃদয়স্পর্শী তিনটি মুহূর্ত। ভাবলাম, আজ এ নিয়ে লিখি। লেখার মধ্য দিয়ে ওই মুহূর্তগুলোর সঙ্গে অন্যদেরও একাত্ম করি। কিন্তু বড্ড গোলমাল হয়ে গেল। হাসির কথায় ঠিক করে ফেললাম, আর লিখব না। কখনোই না।
হাসি, আমার স্ত্রী। লেখালেখির ব্যাপারে কোনো আগ্রহ কখনো দেখাননি। ইতিবাচক বা নেতিবাচক, কোনটিই না। তার পছন্দ-অপছন্দের কোনো ধারণাও আমার নেই। নিজেকে কখনো প্রকাশ করেন না। এ ব্যাপারে বড্ড চাপা। সান্ত্বনা শুধু এটুকু যে, তিনি আমার পেশার বিরোধিতা কখনো করেননি।
আজ তবে গোলমাল বাধল তাঁর কী কথায়? সে কথায় আসছি।
গত তিন রাত কাটিয়েছি অনিদ্রায়; শখের খেলা দেখে। এ বয়সে রাত জাগা কি ঠিক? নেশার কাছে ঠিক-বেঠিক বলে কিছু নেই। আফসোস থাকত না, যদি বাংলাদেশ লড়াই করত। লড়াই তো দূরে থাক, ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারল না। যারা আগেই হেরে যায়, তাদের কে জেতাবে? বলছিলাম, ইডেনের গোলাপি টেস্টের কথা। সোয়া দু দিনেই শেষ হয়ে গেল পাঁচ দিনের টেস্ট। এর আগে ইন্দোরে তিন দিনে হেরেছে। তারও আগে নতুন টেস্ট খেলুড়ে আফগানিস্তান বাংলাদেশকে বাংলাদেশের মাটিতেই হারাল। এ সব হচ্ছেটা কী?
ইডেন টেস্টে বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণের কথা বলেছেন স্বয়ং বিসিবি প্রধান নাজমুল হোসেন পাপন। কারণ হলো, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।’ এ কথার পর আর কারণ জানতে নেই। ওই গল্পের মতো—
-গুলি হলো না কেন?
-একুশটি কারণ আছে।
-প্রথম কারণ, বারুদ ছিল না।
-তাহলে বাকি বিশটি কারণ শোনার প্রয়োজন নেই।
‘ভয়’ই যদি ক্রিকেটারদের ‘মাইন্ড সেট’ হয়ে থাকে, কার কী বলার আছে। শুধুই রাত জাগলাম।
প্রথম আলোর ইব্রাহীম চৌধুরীর কথা শুনলে রাত জাগতে হতো না। তাঁর আমার মতো কোনো নেশা নেই। কথা বলেন সরাসরি, রাখ-ঢাক নেই। রাত জাগার কথা শুনে আমার জন্য গভীর ‘দুঃখ’ প্রকাশ করলেন। বললাম, ‘চৌধুরী, আফসোসটা বিনা যুদ্ধে হেরে যাওয়ার; রাত জাগার নয়।’ ইব্রাহীম চৌধুরীর উত্তর, ‘আপনি আশা করেন কী করে? যতই বলুন দৌড়াও; না জানলে দৌড়াবে কী করে?’
সবকিছুর পর একটা সান্ত্বনা পেলাম। নিয়মিত দর্শক নাজির সিনহা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা পোস্ট দিয়েছেন। এ সপ্তাহে শুধু বাংলাদেশই ইনিংসে হারেনি, ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের কাছে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাকিস্তানও হেরেছে। মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে। আমিও থাকলাম।
রোহিঙ্গা ৪১ জনের আশায় গুঁড়েবালি। দালালেরা শুধু নিষ্ঠুর নয়, ভীষণ বেরসিকও। খবরে দেখলাম, মালয়েশিয়ায় পাঠাবে বলে ট্রলারে তুলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল আলোকোজ্জ্বল সোনাদিয়া দ্বীপে ৪১ রোহিঙ্গাকে নামিয়ে দিয়ে দালালেরা উধাও হয়ে গেছে। বলে গেছে, ‘এটাই মালয়েশিয়া।’ কী নির্মম!
মনে পড়ল ষাটের দশকের এক ঘটনা। ওই সময় সিলেটের গ্রামে-গঞ্জে হিড়িক ছিল লন্ডন যাওয়ার। এ সুযোগ গ্রহণ করে প্রতারক চক্র। লন্ডন পাঠানোর নামে টাকা-কড়ি হাতিয়ে নিয়ে এক লোককে ঢাকা বিমানবন্দরে প্লেনে তুলে দেয়। কিছুক্ষণ পর প্লেন ল্যান্ড করে। প্রতারিত লোকটি ভাবেন, ‘লন্ডন এত কাছে! আধ ঘণ্টায় চলে এলাম! ঘরবাড়ি, লোকজন সব দেখি আমাদের সিলেটের মতো। অবাক ব্যাপার, কথাও বলে সিলেটী।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবিৎ ফিরে পেলেন তিনি। বুঝলেন, প্রতারিত হয়েছেন। দালাল লন্ডনের কথা বলে সিলেটের সালুটিকরমুখী প্নেনে তাঁকে তুলে দিয়েছে। এসব প্রতারক আগেও ছিল, এখনো আছে। শুধু বদলেছে টেকনিক।
মাইকেল ব্লুমবার্গের কথা বলে ফিরে আসব হাসির কথায়। কী বলেছিলেন হাসি। ধনকুবের মাইকেল ব্লুমবার্গ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন লাভের দৌড়ে নাম লেখাচ্ছেন। প্রথম আলোর খবরে দেখলাম, এক সপ্তাহেই বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যয় করবেন ৩১ মিলিয়ন ডলার, যা রেকর্ড। এর আগে এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ব্যয় করেছিলেন বারাক ওবামা, ২৪ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শুধু ডিজিটাল প্রচারণায় ব্লুমবার্গ ব্যয় করবেন ১০ কোটি ডলার।
তাঁর আগমনকে অনেকেই স্বাগত জানাতে যে প্রস্তুত নয়, বার্নি স্যান্ডার্সের বক্তব্যে তার আভাস পাওয়া গেল। ডেমোক্র্যাট ফ্রন্ট রানারদের অন্যতম বার্নি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ধনকুবেররা আমাদের নির্বাচনকে কিনতে চায়।’
কেনা যায় কিনা জানি না, তবে ধনের কিছু মাহাত্ম্য তো থাকেই। রুডলফ জুলিয়ানির পর নিউইয়র্ক নগরীর মেয়র নির্বাচিত হন মাইকেল ব্লুমবার্গ। আইন বা নিয়ম যা-ই বলি না কেন, একজন মেয়রের টার্ম লিমিট দুবার, চার বছর করে দুই মেয়াদে আট বছর কাটানোর পর তার মেয়াদ শেষ। কিন্তু ব্লুমবার্গ চাইলেন, তিনি আরেক মেয়াদে মেয়র হবেন। বাধা হলো আইন; তৃতীয় মেয়াদের অনুমতি নেই। তাতে কী? আইন বদলাও। বাস্তবেও তাই হলো। সিটি কাউন্সিলে বিল পাস করে ব্লুমবার্গের সুবিধার জন্য আইনি বাধাটি অপসারণ করা হলো। তিনি হলেন তৃতীয় দফার মেয়র। এ নিয়ে সে সময় নানা জনে নানা কথা বলেছেন, কে ওতটা মনে রাখে!
একটি ঘটনায় ব্লুমবার্গের ওপর আমার আস্থায় চিড় ধরল। গাজা থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ এবং ইসরায়েলি বিমানের গাজায় নির্বিচার বোমা বর্ষণ, গত দুই দশকে বহুবার ঘটেছে। ইসরায়েলি বোমা বর্ষণে গাজায় শুধু কথিত সন্ত্রাসীরাই নিহত হয়নি, নিহত হয়েছে শত শত নিরীহ শিশু-নারী। অবশ্য পশ্চিমারা ব্যাপক এই নারী-শিশু হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে দেখেছে গাজা থেকে রকেট ছোড়াকে।
বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সির শেষ দিকের ঘটনা। গাজা থেকে ছোড়া দুই/একটি রকেট তেলআবিব বিমানবন্দরের কাছাকাছি গিয়ে আঘাত হানল। এ ঘটনায় বিমান ওঠানামা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় আমেরিকার ফেডারেল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ তেলআবিব বিমানবন্দরে আমেরিকার এয়ারলাইনসগুলোর কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করে। এ সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ইসরায়েল ও আমেরিকায় ইসরায়েলি লবিগুলো। তাদের যুক্তি হলো, তেলআবিব বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে তা ইসরায়েলের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবে।
এ সময় ইসরায়েলের সাহায্যে এগিয়ে এলেন ধনকুবের মাইকেল ব্লুমবার্গ। তিনি ওবামা প্রশাসনের স্থগিতাদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁর নিজস্ব বিমানে আমেরিকার প্রভাবশালী নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে তেলআবিব বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ওখানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। অবশ্য দু-এক দিনের মাথায় ওবামা প্রশাসনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
নিজ সরকারকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ যিনি জানাতে পারেন, তিনি কীভাবে এ জাতির সবার নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? আমার বিবেচনায় বড়জোর তিনি হতে পারেন একটি গোষ্ঠীর অ্যাকটিভিস্ট; আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নন। অবশ্য জনগণ চাইলে অন্য কথা।
এ লেখা যখন লিখছি, তখন খবর এল, সিলেটের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রাণপুরুষ গুলজার আহমদ পরলোকগমন করেছেন। ঢাকা থেকে মুকুল আশরাফের দেওয়া পোস্টে জানলাম, মাত্র দু দিন আগে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। বড় মর্মান্তিক।
গুলজার আহমদ আমাদের কাছে কিংবদন্তিতুল্য। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সিলেটের সভাপতি ছিলেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমরা যখন ছাত্র আন্দোলনের সবক নিচ্ছি, তখন তিনি আমাদের নেতা। তাঁর নেতৃত্বের সম্মোহনী স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল। অন্য একদিন তাঁকে নিয়ে লিখব। তাঁদের দুজনের আত্মার শান্তি কামনা করছি। হাসির কথা বলে আজকের লেখা শেষ করব। আমার লেখা আত্মীয়দের মধ্যে কে পড়েন, কে পড়েন না, সে খবর কখনো নিতে যাইনি। এটা জানতাম, হাসি পড়েন না। কিন্তু তাঁর মন্তব্যে বোঝা গেল, তিনি পড়েন। না পড়লে এমন কঠোর নির্মম মন্তব্য করেন কী করে?
আটলান্টায় থাকে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র আলম। প্রতিটি লেখা সে পড়ে, এ খবর আমি জানি। আরেকজন, আমার বড় বোন ড. সফিকুন্নেসা চৌধুরী; লিংকন হাসপাতালের চিকিৎসক। এখন অবসরে আছেন। তিনি পড়েন। আমার লেখার ব্যাপারে দুবার তাঁর উপদেশ পেয়েছি এবং চেষ্টা করছি তা শোধরাতে। আমার লেখার নেতিবাচক দিক, বিশেষ করে বিষণ্নতার ছায়া, বারবার অসুখ-বিসুখ আর মরণের কথা উল্লেখ করে জীবনবিমুখ হওয়ার আবহ তৈরি করা—এতে তাঁর আপত্তি। তাঁর কথা, ‘এসব পরিহার করো। প্রকৃত মৃত্যুর আগে এ কোন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছ? জীবনমুখী হও।’ তাঁর উপদেশকে স্বাগত জানিয়ে সব বিষণ্নতাকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
গত সপ্তাহে কোনো এক প্রসঙ্গে হাসিকে একটা লেখার কথা বলায় উত্তর দিলেন, ‘তোমার এসব লেখা পড়ি না। খুবই বিরক্তিকর।’
-বিরক্তিকর? কেন, কেন?
-লেখার মধ্যে শুধু ‘আমি’, ‘আমি’। এত ‘আমি’ ‘আমি’ কেন? এই ‘আমি’কে তো জানি, পড়তে হবে কেন?
প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। কী জবাব দেব? এত বড় সমালোচনা। তাও নিজ ঘর থেকে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, ছেড়েই দেব লেখালেখি। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলাম। সমালোচনা সহ্য করতে হবে; হোক ঘরের অথবা বাইরের। বললাম, ‘এই “আমি” তো সেই “আমি” নয়। এই “আমি” কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, এই “আমি” ইতিহাসের এক সাক্ষী, এক বর্ণনাকারী। এই “আমি” যে কেউ হতে পারে—তুমি, আমি, সে, আপনি, তিনি, যে কেউ। “আমি” এখানে তুচ্ছ, নগণ্য’
হাসি নিরুত্তর। সন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে।
আজ আর ‘তিন ফোটা অশ্রু”র কথা বলা হলো না। ভবিষ্যতে একদিন বলব।