https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/242a630cc300c5b9e7cabbdf3f71c7ba-5de0f7e88489d.gif

একজন মুক্তিযোদ্ধার শেষ আর্তি...

by

গত ৩ নভেম্বর ছিল নিউইয়র্ক সিটি ম্যানহাটন ২০১৯ দিবস। এ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১২৫টি দেশ অংশ নেয়। এ জন্য বিশাল এক মঞ্চ তৈরি করা হয়। মঞ্চের চারদিকে শোভা পাচ্ছিল বিভিন্ন দেশের পতাকা। হঠাৎ লাল–সবুজের পতাকায় আমার চোখ আটকে যায়। কাছে গিয়ে তন্ময় হয়ে দেখতে থাকি। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল একটু স্পর্শ করতে। কঠোর নিরাপত্তার কারণে সম্ভব হয়নি। এই পতাকার জন্য আমরা নয় মাস যুদ্ধ করেছি। লক্ষ শহীদের রক্ত আর মা–বোনের ইজ্জতের ফসল আজকের বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানচিত্র।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা আর মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মরহুম সাদেক হোসেন খোকা। সবার প্রিয় খোকা ভাই। একাত্তরের রণাঙ্গনের অকুতোভয় টগবগে তরুণ, মুক্তিযুদ্ধের সূর্য সন্তান, স্বাধীনতার বীর সেনানী ছিলেন সাদেক হোসেন। অন্য পরিচয় হলো তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র, সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ ও একজন সফল সংগঠক।
সাদেক হোসেন আমেরিকায় এসেছিলেন ক্যানসার চিকিৎসার জন্য। দীর্ঘ পাঁচ বছর তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন নিউইয়র্কের বিখ্যাত ক্যানসার হাসপাতালে। কখনো শারীরিক অবস্থার উন্নতি আবার কখনো অবনতি—এভাবে চলছিল চিকিৎসা। এরই মধ্যে তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তিনি ও তাঁর স্ত্রী পাসপোর্ট নবায়নের জন্য নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আবেদন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, দীর্ঘ নয় মাসেও তাঁর পাসপোর্ট নবায়ন করা হয়নি। এরই মধ্যে তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তিনি দেশে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি উপলব্দি করতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে। সরকারের কাছে তিনি দেশে ফেরার আকুতি জানান। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, দেশের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার। কিন্তু তাঁর পাসপোর্ট না হওয়ার কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। যারা নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধারক, বাহক বলে গলা ফাটায়, তারাই জাতির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরেতে দেয়নি।
সাদেক হোসেনের মতো লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধের ফসল আজকের বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানচিত্র আর আমাদের গর্বের লাল–সবুজের পতাকা। যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ বাংলাদেশের পাসপোর্ট বহন করে বিদেশে যাই, আবার আমরাই একাত্তরের সেই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার পাসপোর্ট না দিয়ে তাঁর দেশে আসার পথ রুদ্ধ করে দিই। যে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করলেন, জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পাসপোর্টের অভাবে সেই সাদেক হোসেনের জীবিত দেশে ফেরা হল না। এটা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের সঙ্গে চরম অবমাননা, উপহাস অবজ্ঞা বৈ আর কি!
সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশ! আপেল মাহমুদের সেই বিখ্যাত গান, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ করি।’ আজ মনে হয় যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন, সেই দেশ আজ উল্টো রথে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক উটের পিঠের সাওয়ারি আমার দেশ। সাদেক হোসেনের জানাজা ছিল উত্তর আমেরিকার স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজা। দল–মত ভুলে সব শ্রেণিপেশার মানুষ এতে অংশ নেন। দেশে ও প্রবাসে লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত সাদেক হোসেন চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মায়ের পাশে। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে মাফ করে দিন এবং তাঁকে জান্নাতে স্থান করে দিন। আমিন।