‘মাইনষে হি হইব’র জবাব, ‘ন ডরাই’

by

কথা ছিল, শো শুরু হবে সন্ধ্যা সাতটায়। কিন্তু যতক্ষণে বড় পর্দায় নারী সার্ফারের সংগ্রামের গল্প থেকে উদ্বুদ্ধ ‘ন ডরাই’ শুরু হয়েছে, ততক্ষণে ঘড়িতে রাত আটটা পার হয়ে গেছে। অবশ্য এই দেরির পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে। দেখা গেল, আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যা হলের ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। তখন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ন ডরাইকে দেওয়া হলো আরেকটি হল। পর্দায় শুরু হলো দেশের প্রথম নারী সার্ফারের সংগ্রামের গল্প।

https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/3604788f318516bd0913e775148c454f-5de0fc977bda9.jpg
ছবির মূল প্রোটাগনিস্ট সুনেরাহ বিনতে কামাল ও শরিফুল রাজ। ছবিঃ ফেসবুক

‘ন ডরাই’ বনাম ‘হ ডরাই’

ছবিটি মুক্তির কথা ছিল গত ৮ অক্টোবর, স্টার সিনেপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবিটির ভাষার বিষয়ে আপত্তি জানায়। ৮ অক্টোবর তাই ছবিটি মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। আপত্তিকর জায়গাগুলো সংশোধন করে পুনরায় জমা দেওয়ার পর ২৬ তারিখ সেন্সর ছাড়পত্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলেছে ছবিটি বড় পর্দায় প্রদর্শনযোগ্য করার শেষ মুহূর্তের কাজ। তাই প্রদর্শনীর আগে প্রযোজক বললেন, ‘নো ডরাই না, আমার তো হ ডরাই’ অবস্থা হয়েছিল (অর্থাৎ, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম)।

https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/0fb731b11762ee151e9a036abc315af2-5de0fcba62d6e.jpg
হল ভর্তি দর্শক। ছবিঃ ফেসবুক

যাঁদের হাতে তৈরি ‘ন ডরাই’

প্রথমে বিজ্ঞাপন, মিউজিক ভিডিও ও পরে নাটক নির্মাণ করে পরিচিতি পাওয়া নির্মাতা তানিম রহমান পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘ন ডরাই’। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ‘আদি’। ট্রেইলার আলোচিত হলেও অজ্ঞাত কারণে মুক্তি পায়নি ছবিটি। তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘স্বপ্নের ঘর। ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ছবিটি। ১১ মাস ৮ দিন পর তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্রও দেখল আলোর মুখ। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারপারসন মাহবুব রহমান। মূল প্রোটাগনিস্ট আয়েশার চরিত্রে দেখা দিয়েছেন মডেল ও অভিনয়শিল্পী সুনেরাহ বিনতে কামাল।

১৪ বছর বয়সে সার্ফিংয়ে নাম লেখানো নাসিমা ‘বিগিনার সার্ফিং বিভাগ’ নামের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম হন। আয়েশা চরিত্রটি এই নাসিমা চরিত্রের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। আর পর্দায় আয়েশার প্রেমিকের চরিত্রে দেখা দিয়েছেন শরিফুল রাজ। চিত্রনাট্য লিখেছেন ভারতের শ্যামল সেনগুপ্ত। এর আগে তিনি কলকাতার ‘অন্তহীন’ (২০০৯), ‘বুনো হাঁস’ (২০১৪) ও অমিতাভ বচ্চন ও তাপসী পান্নু অভিনীত পিংক ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন।

https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/fc2541814903a4474f23b18a1c8526f9-5de0fce60135a.jpg
মূল অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে রেদওয়ান রনি ও মিথিলা। ছবিঃ ফেসবুক

প্রিমিয়ারে যাঁরা ছিলেন

রাজধানীর বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ছিল ‘ন ডরাই’ এর প্রিমিয়ার শো। ছবির নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলী ছাড়াও এই রাতে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী ও শিল্পপতি মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, নির্মাতা রেদোয়ান রনি, অনিমেষ আইচ, শিল্পী ও অভিনয়শিল্পী মিথিলা, নাবিলা, সংগীতশিল্পী জেফার রহমান, কৌশিক হোসেন, ফারজানা মুন্নীসহ আরও অনেকে।

প্রত্যাশার উঁচু পারদ ও প্রাপ্তি

শুরু থেকেই সিনেপ্লেক্স প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘ন ডরাই’ নিয়ে প্রত্যাশার পারদ ছিল আকাশচুম্বী। কেমন হয়েছে ‘ন ডরাই’ তা নিয়ে তাই জড়ো হয়েছে মিশ্র মন্তব্য। তবে সিনেমাটোগ্রাফি আর মিউজিককে দর্শক দিয়েছেন ভালো নম্বর। বিশেষ করে সুমন সরকারের সিনেমাটোগ্রাফিকে ফেসবুকে এক দর্শক একটা শব্দে বলেছেন, ‘দুর্দান্ত’। এমন সব দৃশ্য আছে, যেগুলো বাংলাদেশি সিনেমায় এই প্রথম। ‘সাহসী’ বলা যেতে পারে, তবে পরিবার নিয়ে দেখা যাবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

অনেকেই বলেছেন, ‘প্যানপেনে গল্প’। পরের দৃশ্যে কী দেখাবে, বলে দেওয়া যায়। কিছু কিছু দৃশ্য দেখলে মনে হবে, হলিউডের ছবি চলছে। আর কিছু দৃশ্য দেখলে মনে হবে নাটক। তবে বড় পর্দার জন্য দৃষ্টিনন্দন বেশ কয়েকটা ড্রোন ভিউ ছিল। অনেকেই একটা বিষয়ে একমত হয়েছেন যে ছবিটাকে জোর করে টেনে লম্বা বানানো হয়েছে। এক ঘণ্টার দৃশ্য কেটে ফেললেও মূল গল্পের গায়ে তেমন আঁচ লাগত না। তবে এই ছবির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, ‘ন ডরাই’কে নারীরা তাঁদের নতুন স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। বাধা টপকানোর অনুপ্রেরণা পাবেন। সিনেমাটা দেখে প্রতিটা নারী নিজের জীবনের সঙ্গে সামান্য হলেও মেলাতে পারবেন। আর সিনেমা দেখে হল থেকে বের হওয়ার পর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মনে হবে, ‘আমি পারব’।

https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/8ac7ab5ecf08c6e99365019a7d0ee36d-5de0fd462610c.jpg
আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ। ছবিঃ ফেসবুক

‘ন ডরাই’ এর কিছু অভিজ্ঞতা

এই ছবির মূল প্রোটাগনিস্ট, মডেল সুনেরাহ বিনতে কামাল এর আগেও একাধিক ছবির প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু ‘ন ডরাই’ এর আয়েশা চরিত্র সম্বন্ধে জানার পর মনে হলো, এত দিনের অপেক্ষা যেন এই চরিত্রের জন্যই। এরপর নাসিমার সঙ্গে আলাপ, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে মেশা, মুখে সানক্রিন লাগিয়ে সার্ফিং শেখা, আরও কত–কী। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ভোর চারটায় উঠে শুটিংয়ে যেতে কেমন লাগত? সুনেরাহ বিনতে কামালের উত্তর এল, ‘ঘুমালাম কই? রাত দুইটা পর্যন্ত শুটিং করতাম। তিনটায় হোটেলে আসতাম। গোসল করে খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়তাম শুটিংয়ে। লোকেশনে যাওয়ার পথে গাড়িতে হয়তো ঘুমিয়ে নিতাম। ছায়া পেয়ে হয়তো খানিকটা ঝিমিয়ে নিতাম। এভাবেই চলেছে।’ অবশ্য এত কষ্টের ফলও মিলেছে। ফেসবুক চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ–ই এই মডেল কাম অভিনয়শিল্পীর চোখে পড়ল ‘ন ডরাই’ নিয়ে এক দর্শকের অনুভূতি। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘যাক, এই প্রজন্মের সেরা অভিনয়শিল্পীকে পাওয়া গেল। সুনেরাহ বিনতে কামাল।’ যদিও দর্শক হিসেবে প্রথমবার বড় পর্দায় নিজেকে দেখার পর সুনেরাহ বলেছেন, ‘দেখে মনে হলো, কিছু কিছু জায়গায় আরও ভালো হতে পারত।’ এই না হলে অভিনয়শিল্পীর ক্ষুধা!

https://paloimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/1600x0x0/uploads/media/2019/11/29/e043cb39e17eff86a911e4aa8c4cc775-5de0fd694f6bd.jpg
সার্ফিং বোট হাতে সুনেরাহ বিনতে কামাল। ছবিঃ ফেসবুক

ছবির শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ শুটিং হয়েছে কক্সবাজারে। স্থানীয় চাটগাঁইয়া ভাষায়। শুটিংয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শরিফুল রাজ বলেন, ‘শুটিং শুরুর কিছুদিন পরেই প্রযোজক আর পরিচালক বললেন “গানে একটা দৃশ্যে আছে যেখানে দাঁত দিয়ে তোমাকে নারকেল ছিঁড়তে হবে। প্র্যাকটিস করা শুরু করো এটা, যত কম সময়ে কাজটা করতে পারবে, ততই ভালো।” এর আগে জীবনেও আমি এই কাজ করিনি। প্রথমবার দাঁত দিয়ে নারকেল ছিঁড়তে দেখলাম দেড় থেকে দুই মিনিটের মতো লাগে। আর এখন আমি ৩৫ থেকে ৪০ সেকেন্ডের মাঝে একটা নারকেল নিজের দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারি।’

‘ন ডরাই’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে নির্মিত হয়েছে কমিক বইও। নাম দেওয়া হয়েছেন, ‘অ্যাডভেঞ্চার অব আয়েশা’। শিগগিরই দেশের প্রথম নারী সার্ফারের ওপর নির্মিত এই কমিক পাওয়া যাবে স্টার সিনেপ্লেক্সের সমস্ত শাখায় এবং অন্যান্য আউটলেটেও।

দিন শেষে ‘ন ডরাই’ ভয়কে জয় করার গল্প। অনেকগুলো প্রথমকে সঙ্গী করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। সেটিকে স্বাগত না জানানোর কোনো কারণ নেই।